বাংলাদেশ, বৃহস্পতিবার, জুলাই ১০, ২০২৫
বাগমারা

উপজেলার ফটকে চেয়ার-টেবিল পেতে কর্মকর্তাদের খবরদারি

স্বপ্নের বাংলাদেশ বার্তাকক্ষ

স্টাফ রির্পোটার

published: 19 June, 2025, 10:42 PM

উপজেলার ফটকে চেয়ার-টেবিল পেতে কর্মকর্তাদের খবরদারি

আওয়ামী সরকারের পতনের পর থেকে রাজশাহীর বাগমারা উপজেলা বিএনপি আহ্বায়ক ডিএম জিয়াউর রহমান উপজেলা পরিষদের প্রধান ফটকে চেয়ার-টেবিল পেতে বসে থাকেন। সেখানে তিনি রীতিমতো অস্থায়ী দপ্তর বানিয়েছেন। সারাদিন সেখানে বসে সরকারী অফিস নিয়ন্ত্রণ করেন। উপজেলার বিভিন্ন দপ্তরে তদবিরের পাশাপাশি কর্মকর্তাদের খবরদারি করেন।

বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদকের মাধ্যমে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বরাবর দেওয়া এক লিখিত অভিযোগে এমন কথাই বলা হয়েছে। গত ২ জুন কেন্দ্রীয় দপ্তরে এই অভিযোগপত্র গৃহিত হয়েছে। অভিযোগটি দিয়েছেন উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক ও নরদাশ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন; উপজেলা বিএনপির সদস্য ও গোবিন্দপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান, উপজেলা বিএনপির সদস্য ও গণিপুর ইউপির চেয়ারম্যান মো. মনিরুজ্জামান এবং শুভডাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন।

ডিএম জিয়ার বিরুদ্ধে আরো নানা অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলটির ২০০ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করতে একটি এজাহার প্রস্তুত করেছিলেন ডিএম জিয়া। তবে সেই মামলা থানায় দেওয়ার আগেই পাঠানো হয়েছিল আওয়ামী লীগের লোকজনের কাছে। এই মামলার ভয় দেখিয়ে তিনি হাতিয়ে নেন মোটা অংকের টাকা।

মামলা প্রস্তুত করে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর সারা উপজেলায় সমালোচনা শুরু হয়। পরে অবশ্য থানা-পুলিশ মামলাটি গ্রহণ করেনি। বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষ বিএনপির সমালোচনা করছেন। এ অভিযোগে দফায় দফায় পুলিশকে হুমকি, আওয়ামী লীগের সঙ্গে এতদিন আঁতাত করে চলা, দলীয় নেতাকর্মীদেরই নির্যাতন করাসহ নানা অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছে ডিএম জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে। এছাড়া রীতিমতো চেয়ার-টেবিল পেতে তিনি সরকারি দপ্তর নিয়ন্ত্রণ করছেন বলেও অভিযোগ করা হয়েছে।

অভিযোগে বলা হয়, ‘৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে অফিস কক্ষে প্রবেশ করে জিয়াউর রহমান বাগমারার হাটগাঙ্গোপাড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ আকরাম হোসেনকে গালাগাল এবং পেটানোর হুমকি দেন। প্রাণভয়ে আকরাম হোসেন এ ব্যাপারে তার বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে বাধ্য হন। যা এলাকাবাসী সবাই জানে, তদন্ত করলেই এর সত্যতা মিলবে। এই ঘটনায় দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে এবং এলাকাবাসীদের মধ্যে বিরুপ মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে।’



এছাড়া গত ১৬ মে ডিএম জিয়ার মদদে তার ছোট ভাই ডিএম সাফির নেতৃত্বে তাদের অনুসারিরা রক্ষিতপাড়া গ্রামের বিল দখলকে কেন্দ্র করে পাঁচটি বাড়িতে হামলা এবং ভাঙচুর করেন। এ বিষয়ে পুলিশ ব্যবস্থা নিতে গেলে উল্টো পুলিশ ফাড়ির ইনচার্জ সিদ্দিককে মোবাইল ফোনে গুলি করে মেরে ফেলা এবং বোমা মেরে ফাড়ি উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। এ ঘটনায় পুলিশ একটি জিডি করেছে।

ডিএম জিয়ার বিরুদ্ধে দুটি জিডি করার বিষয়ে জানতে চাইলে বাগমারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তৌহিদুল ইসলাম এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি। মঙ্গলবার সকালে তিনি বলেন, ‘চাকরি করি তো ভাই। এসব নিয়ে কথা বলতে চাই না। সমস্যা হবে।’

এদিকে ডিএম জিয়ার বিরুদ্ধে করা অভিযোগে আরও বলা হয়, তিনি পশ্চিম নাককাটি, বিল কালাই ও বিল মালোনিতে তার লোকজন দিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। আওয়ামী লীগের লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে তিনি বিল মালোনি দখল করেন। এ ঘটনার পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরে অভিযোগ হয়। এছাড়া অনেক আওয়ামী লীগ দলীয় লোকজনের পুকুরে তার লোকজন দ্বারা জটিলতা তৈরি করে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। শুভডাঙ্গা, গণিপুর এবং গোবিন্দপাড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান এবং পুকুরের মালিকদের ভয়ভীতি দেখিয়ে আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন এবং এসব ঘটনায় একাধিক সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। এসব বিষয়ে অনেক সময় সেনাবাহিনী এবং পুলিশ-প্রশাসনকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। এতে দলের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুন্ন করেছে।

অভিযোগে বলা হয়, ডিএম জিয়ার অনুসারি রফিক মেম্বারের নেতৃত্বে হামলার শিকার হন নরদাশ ইউপির প্রশাসক হিসেবে থাকা উপজেলা আইসিটি অফিসার। এই ঘটনা নিয়ে পরবর্তীতে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ পর্যন্ত ঘটে। ঘটনাস্থলে ইউএনও, সেনাবাহিনী এবং পুলিশ গিয়ে রফিক মেম্বারকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে আসেন। কিন্তু ডিএম জিয়া তাকে থানা থেকে ছাড়িয়ে নেন।

ডিএম জিয়াউর রহমান টাকার বিনিময়ে আওয়ামী লীগের লোকজনকে রাতারাতি বিএনপি বানিয়ে দিয়েছেন বলেও অভিযোগ করা হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়, বাড়িতে নৌকা মার্কার নির্বাচনী অফিস বানিয়ে ভোট করেছিলেন নরদাশ ইউপির সদস্য রফিকুল ইসলাম। ৫ আগস্টের পরে টাকার বিনিময়ে তাকে বিএনপি বানিয়ে সার্বক্ষণিক সঙ্গে নিয়ে চলাফেরা করছেন ডিএম জিয়া। তাকে নরদাশ ইউপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করে স্থানীয় বিএনপির সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধিয়েছেন। হাটগাঙ্গোপাড়া ফিলিং স্টেশনের মালিক আওয়ামী লীগ নেতা সবুর উদ্দিনকেও টাকার বিনিময়ে বিএনপিতে নিয়েছেন ডিএম জিয়া। গোয়ালকান্দি ইউনিয়নের জেএমবি ক্যাডার মামুন মহুরী, শুভডাঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শাহরিয়ার আলী, ফরিদ উদ্দিন, বাসুপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা তহিদুল ইসলামকেও টাকার বিনিময়ে বিএনপিতে নিয়েছেন। তারা এখন ডিএম জিয়ার সার্বক্ষণিক সঙ্গী।


অভিযোগকারী নেতারা উল্লেখ করেছেন, ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ সালের বাগমারার সাবেক এমপি এনামুল হকের সঙ্গে ডিএম জিয়া সব সময় আঁতাত করে থেকেছেন। তার যথেষ্ট ছবি এবং ভিডিও ফেসবুকে দেখা যায়। এমনকি পার্শ্ববর্তী উপজেলা পবা-মোহনপুর আসনের ২০১৪, ২০১৮ সালের সাবেক এমপি আয়েন উদ্দিন ও ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনের সাবেক এমপি আসাদুজ্জামান আসাদের সঙ্গেও তিনি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতেন। এই তিনজন সংসদ সদস্যের সঙ্গে ডিএম জিয়ার অনেক ছবি এবং ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রয়েছে। তবুও ডিএম জিয়ার বিরুদ্ধে জেলা কমিটি কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনের সময়ও তার ছোট ভাই আউচপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ডিএম সাফি আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী এনামুল হকের পক্ষে ভোট করেন।


অভিযোগে আরও বলা হয়, ডিএম জিয়াউর রহমান ২০১৪ সালে উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে অংশগ্রহণ করলে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় কমিটি। এরপর উল্টো ২০১৭ সালে জেলা বিএনপির তৎকালীন সভাপতি তোফাজ্জল হোসেন তপু তার বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার করে উপজেলা বিএনপির সভাপতি করে পুরষ্কৃত করেন। এরপর থেকে ডিএম জিয়াউর রহমান রাজশাহী শহরে অবস্থান করে জেলা কমিটির নেতাদের ম্যানেজ করে উপজেলা এবং ইউনিয়ন নেতাকর্মীদের ওপর অন্যায়-অবিচার এবং নির্যাতন করে আসছেন। এসব বিষয়ে জেলা বিএনপির শীর্ষ নেতাদের অবহিত করলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। জেলার আসকারা পেয়ে ডিএম জিয়া আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরূপ মনোভাব তৈরী হচ্ছে। তাই দ্রুতই ডিএম জিয়ার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়।

অভিযোগকারীদের একজন উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক ও নরদাশ ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন বলেন, ‘ডিএম জিয়াউর রহমান সব সময়ই দলের পরিপন্থী কাজ করে যাচ্ছেন। এসব তো আমরা পছন্দ করি না। তাই ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কেন্দ্রে লিখিত অভিযোগ করেছি। যাচাই-বাছাই করলেই অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যাবে।’

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএম জিয়াউর রহমান শুধু উপজেলা পরিষদে চেয়ার-টেবিল পেতে অস্থায়ী দপ্তর বানানোর কথা স্বীকার করেন। বাকি সব অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেন তিনি। ডিএম জিয়াউর রহমান বলেন, ‘আমি গরিব মানুষ। আমার কোনো চেম্বার নাই। উপজেলার গেটে একটা ক্যানটিন আছে। আমি যেহেতু উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলাম, গেলে তারা কয়েকটা চেয়ার-টেবিল বের করে দেয়। আমি লোকজন নিয়ে সেখানে বসি।’

জিয়াউর রহমান বলেন, ‘পুলিশ আমার নামে কোনো জিডি করেছে কি না, সেটা আমি জানি না। আমি কারও কাছ থেকে কোনো টাকা-পয়সা নিইনি। ৫ আগস্টের পরে নতুন করে কাউকে বিএনপিও বানাইনি। সব অভিযোগই মিথ্যা। অভিযোগ দিলে দল তদন্ত করবে। তদন্তে সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নিবে। আর সত্যতা না পেলে আমাকে পুরস্কৃত করবে।’

এজাহার প্রস্তুত করে টাকা আদায়ের অভিযোগের বিষয়ে তাঁর জবাব, ‘৫ আগস্টের পরে তো দূরের কথা, গত ২০ বছরেও আমি কোনো এজাহার লিখিনি। থানায় অভিযোগ দিইনি।’ কথা বলতে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সাঈদ চাঁদকে ফোন করা হলে তার নম্বরটি বন্ধ পাওয়া গেছে। সদস্য সচিব বিশ্বনাথ সরকার বলেন, ‘তারা অভিযোগটা দিতে ভুল করেছে। সরাসরি কেন্দ্রে না পাঠিয়ে আমাদের কাছে দিতে পারত। তাহলে আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে পারতাম। কারণ, কেন্দ্রে অভিযোগ গেলেও সেটা আমাদেরকেই দেখতে বলা হয়। ডিএম জিয়ার বিরুদ্ধে এ রকম কোনো অভিযোগ গেছে কি না তা জানি না। কারণ, কেন্দ্র আমাদের কিছু জানায়নি এখনও।’

National