Dhaka 4:11 pm, Monday, 23 December 2024

ভাতা নয়, উপকারভোগী বাড়বে

চলমান অর্থনৈতিক সংকটে দরিদ্ররা যেমন ধুঁকছে, মধ্যবিত্ত পরিবারও রয়েছে তেমনি শোচনীয় পর্যায়ে, যার বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে বাজারের কেনাবেচায়। সংসারের অতি জরুরি নিত্যপণ্যের প্রয়োজনও মেটাতে পারছেন না অনেকেই। বিষয়টির প্রতি আগামী বাজেটে সরকার বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। নতুন বাজেটে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির জেরে হিমশিম খাওয়া জনগোষ্ঠীকে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনা হবে।

 

তবে সংকোচনমূলক বাজেটে ভাতা বাড়াবে না সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, সংকটময় পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিদ্যমান ভাতার হার অপরিবর্তিত রেখেই নতুনদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে যুক্ত করা হবে। এই প্রক্রিয়ায় বেশি মানুষকে সুবিধা দিতে চায় সরকার।

 

আগামী অর্থবছরের বাজেটে নতুন করে চার লাখেরও বেশি উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর ঘোষণা আসতে পারে। এ ছাড়া দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে ওএমএসসহ খাদ্য সহায়তা কর্মসূচিতেও নতুন মুখ যুক্ত করা হতে পারে। পাশাপাশি দেশের সব প্রতিবন্ধীকে ভাতার আওতায় আনা হবে। চলতি অর্থবছরে নতুনভাবে দরিদ্র হওয়া জনগোষ্ঠী সামাজিক সুরক্ষার সুবিধা পাচ্ছে না।

 

তাদের যুক্ত করতেই সরকার এবার এমন পরিকল্পনা নিতে যাচ্ছে, যা আগামী অর্থবছরের বাজেটে কার্যকর করা হবে।

 

সম্প্রতি আগামী অর্থবছরের বাজেটের রূপরেখা নিয়ে আলোচনায় খাতভিত্তিক ব্যয় পরিকল্পনা প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করা হয়। এ সময় সামাজিক সুরক্ষায় আরো নজর দিতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ বিষয়ে সামাজিক সুরক্ষার আওতা বাড়াতে আগামী বাজেটে ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানোর পরিকল্পনার কথা প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

প্রধানমন্ত্রীর কাছে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাবিত বাজেটের রূপরেখা উপস্থাপনের পর অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান জানিয়েছেন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়বে।

মূল্যস্ফীতির চাপে থাকা কম আয়ের মানুষকে স্বস্তি দিতে এ সুবিধা বাড়ানো হচ্ছে।

 

এর আগে গত মাসে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি নিয়ে মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে নতুন সুবিধাভোগীদের অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে বেশির ভাগ ভাতার পরিমাণ অপরিবর্তিত রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আগামী বাজেটে এর প্রতিফলন ঘটবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

গত সপ্তাহে সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, প্রান্তিক পর্যায়ে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়াতে সরকার বিভিন্ন ভাতার ব্যবস্থা করেছে। প্রয়োজনে আরো বেশি মানুষকে এই ভাতা দেওয়া হবে। বর্তমানে সব কিছু অনলাইনে হওয়ায় ভাতাপ্রাপ্তিতে কোনো দুর্নীতির সুযোগ নেই। তবে সুবিধাভোগী বাছাইয়ে কোনো অনিয়মের তথ্য পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আগামী দিনে উপজেলা পর্যায়ে প্রতিবন্ধীদের সহায়তাকেন্দ্র খোলার পরিকল্পনার কথা জানান তিনি।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় সুবিধাভোগীর সংখ্যা আরো চার লাখ বাড়াবে সরকার। বর্তমানে প্রায় এক কোটি ১৪ লাখ বয়স্ক মানুষ, বিধবা বা স্বামী-নিগৃহীতা নারী ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এই ভাতা পাচ্ছে। তাদের ভাতার হার মাসে ৫৫০ থেকে ৮৫০ টাকা পর্যন্ত।

ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতিতে আগে থেকে কশাঘাতে থাকা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বাজেটে তেমন সুখবর নেই। তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য চাল, ডাল, তেল, আলু, ডিম ও মসলাজাতীয় পণ্যের জোগান দিতে হিমশিম খাচ্ছে। টানা প্রায় ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতির কারণে এমনকি অনেক প্রয়োজন বাদ দিয়েও এখন খাদ্যপণ্যের চাহিদা মেটাতে পারছে না। এ অবস্থায়ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বয়স্ক ও দুস্থ মানুষের ভাতার পরিমাণ বাড়বে না।

এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়হার ও ঋণের সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত। তবে এর ফলে কম আয়ের মানুষের চাপ বেড়েছে। সাময়িকভাবে এই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সরকারের প্রস্তুতি নেওয়ার কথা আমরা বলেছি, যাতে আগামী অর্থবছরের বাজেটে দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য সহায়ক পদক্ষেপ নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকারের ভাতার পরিমাণ বাড়ানোর পাশাপাশি অন্যান্য পদক্ষেপ থাকা প্রয়োজন, যাতে অতি সহজে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।’

জানা যায়, সরকার প্রায় ১৩০টি কর্মসূচির আওতায় সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী সুবিধা দিচ্ছে। চলতি অর্থবছরের জন্য মোট বরাদ্দ এক লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে এর পরিমাণ প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা হতে পারে বলে জানিয়েছেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা।

চলতি অর্থবছরে ৫৮ লাখ এক হাজার বয়স্ক নাগরিক ভাতার আওতায় রয়েছেন। এ খাতে বরাদ্দ রয়েছে প্রায় চার হাজার ২০৬ কোটি টাকা। ৯০ বছর বা এর বেশি বয়স্কদের ভাতা বৃদ্ধির পাশাপাশি উপকারভোগীর সংখ্যা আরো দুই লাখ বাড়ানোর লক্ষ্য থাকায় ব্যয়ের পরিমাণ প্রায় ২২০ কোটি টাকা বাড়তে পারে। এ জন্য আগামী অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে চার হাজার ৪২৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা রাখা হচ্ছে।

চলতি অর্থবছরে ২৫ লাখ ৭৫ হাজার বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা নারীর ভাতার জন্য এক হাজার ৭১১ কোটি ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। বর্তমানে তাঁরা প্রতি মাসে ৫৫০ টাকা ভাতা পাচ্ছেন। আগামী অর্থবছরে বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতাদের ভাতা বাবদ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে এক হাজার ৯৩০ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। আরো এক লাখ নারী এ ভাতার আওতায় আসবেন।

বর্তমানে ২৯ লাখ ৮৭ হাজার অসচ্ছল প্রতিবন্ধী মাসে ৮৫০ টাকা করে ভাতা পায়। চলতি অর্থবছরে এতে বরাদ্দ রয়েছে দুই হাজার ৯৭৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা। আগামী অর্থবছরে আরো এক লাখ প্রতিবন্ধী ভাতার আওতায় আসবে। তবে ভাতার পরিমাণ অপরিবর্তিত থাকবে। নতুন উপকারভোগী যুক্ত হওয়ায় এ খাতে বরাদ্দ বেড়ে তিন হাজার ১৯৮ কোটি টাকায় উন্নীত হতে পারে।

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মাসিক সম্মানী ৩০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। বর্তমানে বীর মুক্তিযোদ্ধারা মাসে ২০ হাজার টাকা করে সম্মানি পান।

এ ছাড়া আগামী অর্থবছর থেকে ৯০ বছর বা তার বেশি বয়সী ব্যক্তিদের জন্য ভাতার পরিমাণ বাড়াতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও পরিকল্পনা বিভাগ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আগামী অর্থবছরে তাঁদের মাসিক ভাতার পরিমাণ ৬০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০০ টাকা নির্ধারণ করা হচ্ছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের তৈরি করা সামাজিক সুরক্ষা সেক্টর অ্যাকশন প্ল্যান অনুযায়ী, দেশের ৬০ বছরের বেশি বয়সী সব নাগরিককে বয়স্ক ভাতার আওতায় আনার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর উপকারভোগীদের তালিকা যাচাই করে প্রকৃত দরিদ্রদের সুবিধা দেওয়া এবং এ খাতে বরাদ্দের হার বাড়িয়ে জিডিপির ৩ শতাংশে উন্নীত করার সুপারিশ করা হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে চলতি অর্থবছরে জিডিপির ২.৫২ শতাংশ বরাদ্দ রয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকার কম আয় করেন এমন ৬৫ বছরের বেশি বয়সী পুরুষ ও ৬২ বছরের বেশি বয়সী নারীরা বয়স্ক ভাতার আওতায় রয়েছেন। বর্তমানে তাঁরা মাসে ৬০০ টাকা করে ভাতা পাচ্ছেন। চলতি অর্থবছরে দেশের ২৬২ উপজেলায় সব যোগ্য প্রবীণ নাগরিক এ সুবিধা পাচ্ছেন। বাকি ২৩৩ উপজেলার সব যোগ্য ব্যক্তিকে বয়স্ক ভাতার আওতায় আনলে উপকারভোগীর সংখ্যা আরো আট লাখ বাড়াতে হবে।

ভাতার বাইরে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে নতুন অর্থবছরে বরাদ্দ বাড়বে। এর মধ্যে শারীরিক প্রতিবন্ধী কল্যাণ ট্রাস্ট, নিউরো ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট, ৭৪টি বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী স্কুল, ১৩টি শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র এবং ১০৩টি প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রের অনুকূলে চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো হবে। এ ছাড়া ছোটমণি নিবাস, সমন্বিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো, সরকারি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়, সরকারি শিশু পরিবার এবং মহিলা ও শিশু-কিশোরী হেফাজতিদের নিরাপদ আবাসন কেন্দ্রগুলোর বরাদ্দ বাড়বে।

গত এপ্রিলে শুরুতে দেওয়া পরিপত্রে মন্ত্রণালয় জানায়, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সব টাকা উপকারভোগীর জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে নিবন্ধিত মোবাইল ফিন্যানশিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) মাধ্যমে দিতে হবে। ২০২৫ সালের ৩০ জুনের মধ্যে তা নিশ্চিত করতে হবে।

জানা যায়, চলতি অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তায় মোট এক লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। বয়স্ক, বিধবা, পেনশনভোগী, মুক্তিযোদ্ধা, বেদে, হিজড়াসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর এক কোটি ৩৮ লাখ ৬৪ হাজার ব্যক্তিকে নগদ ভাতা দিতে বরাদ্দ রয়েছে ৪৩ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে আট লাখ নন-ক্যাডার সরকারি কর্মচারী পেনশনভোগীর জন্য বরাদ্দ ২৭ হাজার ৪১৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ মাত্র ৫.৭৭ শতাংশ উপকারভোগী এ খাতে মোট বরাদ্দের ৬৩.১৮ শতাংশ পাচ্ছেন।

সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) প্রতিনিধি অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় সংকোচনমূলক নীতির পাশাপাশি দরিদ্রের জন্য সহায়ক ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। সংস্থাটি আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে এই ভাতার পরিমাণ আরো বাড়ানোর কথা বলেছে। একই সঙ্গে এ বিষয়ে অনিয়ম রোধের তাগিদ দিয়ে বলেছে, উপকারভোগী সঠিকভাবে নির্বাচন করা হয় না। ফলে এ বিষয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা জরুরি।

ভাতা বৃদ্ধির পক্ষে যুক্তি দিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে সামনে আনে আইএমএফ। সংস্থাটি বলেছে, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি থাকা উচিত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য। তাদের জন্য কর্মসূচিগুলোর সম্প্রসারণ করা উচিত। আইএমএফকে অর্থ বিভাগ জানিয়েছে, আগামী বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় কয়েকটি কর্মসূচিতে উপকারভোগী বাড়ানো হবে। সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে আগামী বাজেট ছোট রাখায় ভাতার হার আপাতত বাড়বে না।

ট্যাগস :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয়
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com

ভাতা নয়, উপকারভোগী বাড়বে

আপলোড সময় : 01:56:05 pm, Tuesday, 28 May 2024

চলমান অর্থনৈতিক সংকটে দরিদ্ররা যেমন ধুঁকছে, মধ্যবিত্ত পরিবারও রয়েছে তেমনি শোচনীয় পর্যায়ে, যার বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে বাজারের কেনাবেচায়। সংসারের অতি জরুরি নিত্যপণ্যের প্রয়োজনও মেটাতে পারছেন না অনেকেই। বিষয়টির প্রতি আগামী বাজেটে সরকার বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। নতুন বাজেটে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির জেরে হিমশিম খাওয়া জনগোষ্ঠীকে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনা হবে।

 

তবে সংকোচনমূলক বাজেটে ভাতা বাড়াবে না সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, সংকটময় পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিদ্যমান ভাতার হার অপরিবর্তিত রেখেই নতুনদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে যুক্ত করা হবে। এই প্রক্রিয়ায় বেশি মানুষকে সুবিধা দিতে চায় সরকার।

 

আগামী অর্থবছরের বাজেটে নতুন করে চার লাখেরও বেশি উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর ঘোষণা আসতে পারে। এ ছাড়া দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে ওএমএসসহ খাদ্য সহায়তা কর্মসূচিতেও নতুন মুখ যুক্ত করা হতে পারে। পাশাপাশি দেশের সব প্রতিবন্ধীকে ভাতার আওতায় আনা হবে। চলতি অর্থবছরে নতুনভাবে দরিদ্র হওয়া জনগোষ্ঠী সামাজিক সুরক্ষার সুবিধা পাচ্ছে না।

 

তাদের যুক্ত করতেই সরকার এবার এমন পরিকল্পনা নিতে যাচ্ছে, যা আগামী অর্থবছরের বাজেটে কার্যকর করা হবে।

 

সম্প্রতি আগামী অর্থবছরের বাজেটের রূপরেখা নিয়ে আলোচনায় খাতভিত্তিক ব্যয় পরিকল্পনা প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করা হয়। এ সময় সামাজিক সুরক্ষায় আরো নজর দিতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ বিষয়ে সামাজিক সুরক্ষার আওতা বাড়াতে আগামী বাজেটে ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানোর পরিকল্পনার কথা প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

প্রধানমন্ত্রীর কাছে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাবিত বাজেটের রূপরেখা উপস্থাপনের পর অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান জানিয়েছেন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়বে।

মূল্যস্ফীতির চাপে থাকা কম আয়ের মানুষকে স্বস্তি দিতে এ সুবিধা বাড়ানো হচ্ছে।

 

এর আগে গত মাসে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি নিয়ে মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে নতুন সুবিধাভোগীদের অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে বেশির ভাগ ভাতার পরিমাণ অপরিবর্তিত রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আগামী বাজেটে এর প্রতিফলন ঘটবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

গত সপ্তাহে সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, প্রান্তিক পর্যায়ে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়াতে সরকার বিভিন্ন ভাতার ব্যবস্থা করেছে। প্রয়োজনে আরো বেশি মানুষকে এই ভাতা দেওয়া হবে। বর্তমানে সব কিছু অনলাইনে হওয়ায় ভাতাপ্রাপ্তিতে কোনো দুর্নীতির সুযোগ নেই। তবে সুবিধাভোগী বাছাইয়ে কোনো অনিয়মের তথ্য পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আগামী দিনে উপজেলা পর্যায়ে প্রতিবন্ধীদের সহায়তাকেন্দ্র খোলার পরিকল্পনার কথা জানান তিনি।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় সুবিধাভোগীর সংখ্যা আরো চার লাখ বাড়াবে সরকার। বর্তমানে প্রায় এক কোটি ১৪ লাখ বয়স্ক মানুষ, বিধবা বা স্বামী-নিগৃহীতা নারী ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এই ভাতা পাচ্ছে। তাদের ভাতার হার মাসে ৫৫০ থেকে ৮৫০ টাকা পর্যন্ত।

ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতিতে আগে থেকে কশাঘাতে থাকা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বাজেটে তেমন সুখবর নেই। তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য চাল, ডাল, তেল, আলু, ডিম ও মসলাজাতীয় পণ্যের জোগান দিতে হিমশিম খাচ্ছে। টানা প্রায় ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতির কারণে এমনকি অনেক প্রয়োজন বাদ দিয়েও এখন খাদ্যপণ্যের চাহিদা মেটাতে পারছে না। এ অবস্থায়ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বয়স্ক ও দুস্থ মানুষের ভাতার পরিমাণ বাড়বে না।

এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়হার ও ঋণের সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত। তবে এর ফলে কম আয়ের মানুষের চাপ বেড়েছে। সাময়িকভাবে এই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সরকারের প্রস্তুতি নেওয়ার কথা আমরা বলেছি, যাতে আগামী অর্থবছরের বাজেটে দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য সহায়ক পদক্ষেপ নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকারের ভাতার পরিমাণ বাড়ানোর পাশাপাশি অন্যান্য পদক্ষেপ থাকা প্রয়োজন, যাতে অতি সহজে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।’

জানা যায়, সরকার প্রায় ১৩০টি কর্মসূচির আওতায় সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী সুবিধা দিচ্ছে। চলতি অর্থবছরের জন্য মোট বরাদ্দ এক লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে এর পরিমাণ প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা হতে পারে বলে জানিয়েছেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা।

চলতি অর্থবছরে ৫৮ লাখ এক হাজার বয়স্ক নাগরিক ভাতার আওতায় রয়েছেন। এ খাতে বরাদ্দ রয়েছে প্রায় চার হাজার ২০৬ কোটি টাকা। ৯০ বছর বা এর বেশি বয়স্কদের ভাতা বৃদ্ধির পাশাপাশি উপকারভোগীর সংখ্যা আরো দুই লাখ বাড়ানোর লক্ষ্য থাকায় ব্যয়ের পরিমাণ প্রায় ২২০ কোটি টাকা বাড়তে পারে। এ জন্য আগামী অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে চার হাজার ৪২৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা রাখা হচ্ছে।

চলতি অর্থবছরে ২৫ লাখ ৭৫ হাজার বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা নারীর ভাতার জন্য এক হাজার ৭১১ কোটি ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। বর্তমানে তাঁরা প্রতি মাসে ৫৫০ টাকা ভাতা পাচ্ছেন। আগামী অর্থবছরে বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতাদের ভাতা বাবদ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে এক হাজার ৯৩০ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। আরো এক লাখ নারী এ ভাতার আওতায় আসবেন।

বর্তমানে ২৯ লাখ ৮৭ হাজার অসচ্ছল প্রতিবন্ধী মাসে ৮৫০ টাকা করে ভাতা পায়। চলতি অর্থবছরে এতে বরাদ্দ রয়েছে দুই হাজার ৯৭৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা। আগামী অর্থবছরে আরো এক লাখ প্রতিবন্ধী ভাতার আওতায় আসবে। তবে ভাতার পরিমাণ অপরিবর্তিত থাকবে। নতুন উপকারভোগী যুক্ত হওয়ায় এ খাতে বরাদ্দ বেড়ে তিন হাজার ১৯৮ কোটি টাকায় উন্নীত হতে পারে।

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মাসিক সম্মানী ৩০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। বর্তমানে বীর মুক্তিযোদ্ধারা মাসে ২০ হাজার টাকা করে সম্মানি পান।

এ ছাড়া আগামী অর্থবছর থেকে ৯০ বছর বা তার বেশি বয়সী ব্যক্তিদের জন্য ভাতার পরিমাণ বাড়াতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও পরিকল্পনা বিভাগ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আগামী অর্থবছরে তাঁদের মাসিক ভাতার পরিমাণ ৬০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০০ টাকা নির্ধারণ করা হচ্ছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের তৈরি করা সামাজিক সুরক্ষা সেক্টর অ্যাকশন প্ল্যান অনুযায়ী, দেশের ৬০ বছরের বেশি বয়সী সব নাগরিককে বয়স্ক ভাতার আওতায় আনার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর উপকারভোগীদের তালিকা যাচাই করে প্রকৃত দরিদ্রদের সুবিধা দেওয়া এবং এ খাতে বরাদ্দের হার বাড়িয়ে জিডিপির ৩ শতাংশে উন্নীত করার সুপারিশ করা হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে চলতি অর্থবছরে জিডিপির ২.৫২ শতাংশ বরাদ্দ রয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকার কম আয় করেন এমন ৬৫ বছরের বেশি বয়সী পুরুষ ও ৬২ বছরের বেশি বয়সী নারীরা বয়স্ক ভাতার আওতায় রয়েছেন। বর্তমানে তাঁরা মাসে ৬০০ টাকা করে ভাতা পাচ্ছেন। চলতি অর্থবছরে দেশের ২৬২ উপজেলায় সব যোগ্য প্রবীণ নাগরিক এ সুবিধা পাচ্ছেন। বাকি ২৩৩ উপজেলার সব যোগ্য ব্যক্তিকে বয়স্ক ভাতার আওতায় আনলে উপকারভোগীর সংখ্যা আরো আট লাখ বাড়াতে হবে।

ভাতার বাইরে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে নতুন অর্থবছরে বরাদ্দ বাড়বে। এর মধ্যে শারীরিক প্রতিবন্ধী কল্যাণ ট্রাস্ট, নিউরো ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট, ৭৪টি বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী স্কুল, ১৩টি শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্র এবং ১০৩টি প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রের অনুকূলে চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো হবে। এ ছাড়া ছোটমণি নিবাস, সমন্বিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো, সরকারি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়, সরকারি শিশু পরিবার এবং মহিলা ও শিশু-কিশোরী হেফাজতিদের নিরাপদ আবাসন কেন্দ্রগুলোর বরাদ্দ বাড়বে।

গত এপ্রিলে শুরুতে দেওয়া পরিপত্রে মন্ত্রণালয় জানায়, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সব টাকা উপকারভোগীর জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে নিবন্ধিত মোবাইল ফিন্যানশিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) মাধ্যমে দিতে হবে। ২০২৫ সালের ৩০ জুনের মধ্যে তা নিশ্চিত করতে হবে।

জানা যায়, চলতি অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তায় মোট এক লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। বয়স্ক, বিধবা, পেনশনভোগী, মুক্তিযোদ্ধা, বেদে, হিজড়াসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর এক কোটি ৩৮ লাখ ৬৪ হাজার ব্যক্তিকে নগদ ভাতা দিতে বরাদ্দ রয়েছে ৪৩ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে আট লাখ নন-ক্যাডার সরকারি কর্মচারী পেনশনভোগীর জন্য বরাদ্দ ২৭ হাজার ৪১৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ মাত্র ৫.৭৭ শতাংশ উপকারভোগী এ খাতে মোট বরাদ্দের ৬৩.১৮ শতাংশ পাচ্ছেন।

সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) প্রতিনিধি অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় সংকোচনমূলক নীতির পাশাপাশি দরিদ্রের জন্য সহায়ক ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। সংস্থাটি আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে এই ভাতার পরিমাণ আরো বাড়ানোর কথা বলেছে। একই সঙ্গে এ বিষয়ে অনিয়ম রোধের তাগিদ দিয়ে বলেছে, উপকারভোগী সঠিকভাবে নির্বাচন করা হয় না। ফলে এ বিষয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা জরুরি।

ভাতা বৃদ্ধির পক্ষে যুক্তি দিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে সামনে আনে আইএমএফ। সংস্থাটি বলেছে, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি থাকা উচিত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য। তাদের জন্য কর্মসূচিগুলোর সম্প্রসারণ করা উচিত। আইএমএফকে অর্থ বিভাগ জানিয়েছে, আগামী বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় কয়েকটি কর্মসূচিতে উপকারভোগী বাড়ানো হবে। সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে আগামী বাজেট ছোট রাখায় ভাতার হার আপাতত বাড়বে না।