সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের নিয়োগে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে (নবম থেকে ১৩ গ্রেড) মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল সরকারের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা নিয়ে হাইকোর্টের দেওয়া এক পাতার আংশিক রায় প্রকাশিত হয়েছে। বিচারপতি কেএম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের দ্বৈত বেঞ্চের দেওয়া রায়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রকাশিত হয়। এতে সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা ও অন্যান্য কোটা বজায় রাখতে নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে, সরকার প্রয়োজন মনে করলে কোটার হার পরিবর্তন-পরিবর্ধন, হ্রাস বা বৃদ্ধি করতে পারবে। হাইকোর্টের রায়ে আরও বলা হয়েছে, কোটার ভিত্তিতে কোনো চাকরিপ্রার্থী পাওয়া না গেলে সাধারণ মেধা তালিকার মাধ্যমে তা পূরণ করা যাবে এবং হাইকোর্টের এ রায় এ ক্ষেত্রে বাধা হবে না। গত ৫ জুন এ রায় দিয়েছিল হাইকোর্টের এই বেঞ্চ। গত বুধবার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কোটা নিয়ে বিষয়বস্তুর ওপর চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থার আদেশ দিয়েছে।
এদিকে হাইকোর্টের এই সংক্ষিপ্ত রায়ের বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা এএম আমিন উদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আংশিক রায় (রায় ঘোষণার পর পূর্ণাঙ্গ রায়) কখনো হয় না। এটা কোনো জাজমেন্ট (রায়) নয়। এটা হয় তো রায়ের কোনো একটা অংশ হতে পারে। এখানে বিষয়বস্তু, সাবমিশনটা কী? এটাতে তো নেই। আমার অভিজ্ঞতায় এ ধরনের রায় কখনো দেখিনি। তাই এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না।’
২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর ওই পরিপত্রে নবম গ্রেড (পূর্বতন প্রথম শ্রেণি) এবং ১০ম থেকে ১৩তম গ্রেডের (পূর্বতন দ্বিতীয় শ্রেণি) পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হবে বলে উল্লেখ করা হয় এবং এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটাপদ্ধতি বাতিল করা হয়। এই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন সরকারি চাকরিপ্রার্থী ময়মনসিংহের ফুলপুরের অহিদুল ইসলামসহ সাত শিক্ষার্থী। শুনানি নিয়ে ২০২১ সালের ৭ ডিসেম্বর এই পরিপত্রের বৈধতা প্রশ্নে রুল দেয় হাইকোর্ট। মন্ত্রিপরিষদ সচিব, জনপ্রশাসন সচিব, মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সচিব, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যানকে রুলের জবাব দিতে বলে আদালত। রুল যথাযথ ঘোষণা করে গত ৫ জুন এক রায়ে কোটা বাতিল-সংক্রান্ত ওই পরিপত্র অবৈধ ও বাতিল বলে ঘোষণা করে হাইকোর্ট। সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা তখন জানান, এ রায়ের ফলে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটার বিষয়টি পুনর্বহাল হলো।
হাইকোর্টের রায়ের পর থেকে কোটা বাতিল ও সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা, যা এখনো চলছে।
হাইকোর্টের এ রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার আদলতে আবেদন করলে গত ৯ জুন চেম্বার আদালত আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে বিষয়টির ওপর শুনানি করতে ৪ জুলাই ধার্য করে। ওইদিন (৪ জুলাই) প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত আপিল বিভাগ রাষ্ট্রপক্ষকে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের নির্দেশনা দিয়ে শুনানি মুলতবি (নট টুডে) করে। এমন পরিস্থিতিতে গত ৯ জুলাই হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে হলফনামার অনুমতি নিতে চেম্বার আদালতে আবেদন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী। চেম্বার আদালত হলফনামা গ্রহণ করে বিষয়টি আপিল বিভাগে পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য ১০ জুলাই ধার্য করে। ওইদিন আপিল বিভাগ রাষ্ট্রপক্ষ ও দুই শিক্ষার্থীর আবেদনের ওপর শুনানি নিয়ে কোটা নিয়ে বিষয়বস্তুর (সাবজেক্ট ম্যাটার) ওপর চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা দেয়। একই সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষকে হাইকোর্টের রায়ের অনুলিপি পাওয়া সাপেক্ষে নিয়মিত আপিলের নির্দেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত।
এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল হাইকোর্টের এই সংক্ষিপ্ত রায় প্রকাশ হয়। রায়ে আদালত বলে, ‘২০১২ সালে করা রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের রায় ও আদেশ, ২০১৩ সালের আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগে তা বহাল ও সংশোধিত আদেশ এবং ২০১১ সালের ১৬ জানুয়ারির সরকারি আদেশের আলোকে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান/নাতি-নাতনিদের জন্য কোটা পুনর্বহাল করতে বিবাদীদের (রিট মামলার বিবাদী) নির্দেশ দেওয়া হলো।’ একই সঙ্গে রায়ে, জেলা, নারী, প্রতিবন্ধী, আদিবাসী, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীসহ অন্যান্য কেউ থাকলে, সে ক্ষেত্রে কোটা বজায় রাখতে নির্দেশ দিয়ে এই আদেশ পাওয়ার তিন মাসের মধ্যে পরিপত্র জারি করতে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। রায়ে আরও বলা হয়, ‘প্রয়োজনে উল্লিখিত শ্রেণির ক্ষেত্রে কোটা পরিবর্তন ও হার কমানো বা বাড়ানোর বিষয়ে এই রায় বিবাদীদের জন্য কোনো বাধা তৈরি হবে না।’ এ ছাড়া যেকোনো পাবলিক পরীক্ষায় কোটার মাধ্যমে প্রার্থিতা পূরণ না হলে সাধারণ মেধাতালিকা থেকে শূন্যপদ পূরণ করার বিষয়ে বিবাদীদের (সরকার) স্বাধীনতা থাকছে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়।