নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বর্তমানে রুফটপ সোলার বাণিজ্যিকভাবে প্রসারণ হচ্ছে। বিশেষত শিল্প খাতে এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহারে বাড়ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন। রুফটপ সোলারের লাভজনক দিকগুলো তুলে ধরা গেলে দেশে বিনিয়োগ ও বাজার—দুটোই আরো বড় হবে। ‘বাংলাদেশে রুফটপ সোলার সিস্টেম: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক ওয়েবিনারে অংশ নেয়া বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়গুলো তুলে ধরেন। ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল) ও বণিক বার্তা যৌথভাবে গতকাল ওয়েবিনারটির আয়োজন করে।
স্বাগত বক্তব্যে ইডকলের নির্বাহী পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আলমগীর মোরসেদ বলেন, ‘ইডকল ৭ বছর ধরে বিদ্যুৎ খাতের অবকাঠামো নির্মাণে সহায়তা করছে, বিশেষত অর্থায়ন ও কারিগরি সহায়তায়। ইডকলের বড় কর্মসূচিগুলোর মধ্যে বর্তমানে বাংলাদেশে শিল্প খাতে রুফটপ সোলার ব্যবহার বাড়ছে। রুফটপ থেকে বর্তমানে তিন-পাঁচ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। ইডকলের সোলার হোম সিস্টেমের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে রুফটপেও বড় ভূমিকা রাখা যাবে।’
রুফটপ সোলার নিয়ে ইডকলের উদ্যোগটি অনুপ্রেরণামূলক মন্তব্য করে বণিক বার্তার সম্পাদক ও প্রকাশক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ স্বাগত বক্তব্যে বলেন, ‘বাংলাদেশে যারা শিল্পে পাইওনিয়ার, তারা এখন চিন্তা করছেন কীভাবে এনার্জি এফিশিয়েন্ট হবেন। কীভাবে তারা জ্বালানি সাশ্রয়ী হতে পারবেন। সেক্ষেত্রে একটা বড় জায়গা তৈরি করেছে গ্রিন এনার্জি, বিশেষত রুফটপ সোলার। ইডকল এক্ষেত্রে একটা লিডারশিপ নিয়েছে।’
সোলার থেকে বিদ্যুৎ তৈরিতে উৎপাদন ও বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রণোদনার বিষয়টি উল্লেখ করেন ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) সেন্টার ফর এনার্জি রিসার্চের পরিচালক মো. শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী। আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি বলেন, ‘বিদ্যুতের ইউটিলিটিগুলো থেকে তেমন কোনো সহযোগিতা পাওয়া যা না। এর কারণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে, ইউটিলিটিগুলোর জন্য পলিসি গাইডলাইনে সরাসরি কোনো প্রণোদনা পাওয়ার সুযোগ নেই। নেট মিটারিংয়ের আওতায় যেহেতু বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমে আসছে, সেক্ষেত্রে ইউটিলিটিগুলোকে যদি হুইলিং চার্জ দেয়া যায় তাহলে তাদের জন্য লাভজনক হবে এবং ইউটিলিটিগুলো এ সেবা দিতে আগ্রহী হবে।’
বাংলাদেশ পাওয়ার ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটের (বিপিএমআই) রেক্টর মোহাম্মদ আলাউদ্দিন বলেন, ‘নেট এনার্জি মিটারিং সিস্টেম গাইডলাইনে সব ধরনের গ্রাহক নেট স্কিমিং মিটারিংয়ের আওতায় নেই। শুধু থ্রি ফেজ কনজিউমাররা এর আওতায় আসবেন। আর নবায়নযোগ্য জ্বালানি সরবরাহে ইউটিলিটি কোম্পানিগুলোর আগ্রহ কম। তাদের আগ্রহী করতে এখানে প্রণোদনার আওতায় নিয়ে আসতে হবে।’
বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ খাতে বিশ্বব্যাংক, কেএফডব্লিউ, এডিবি, জাইকাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ফাইন্যান্সের সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে জানান জার্মান দাতা সংস্থা কেএফডব্লিউ বাংলাদেশের ডেপুটি ডিরেক্টর তাজমিলুর রহমান। এর পরও বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করেছিলাম, ২০২৪ সালের মধ্যে আমাদের ৬০ মিলিয়ন ইউরো শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু সেটা হয়নি, এখনো অনেক বাকি আছে। তার মানে এখনো আমাদের অনেক প্রতিবন্ধকতা আছে, যা অতিক্রম করতে হবে। এটা অনেক লাভবান প্রকল্প হওয়া সত্ত্বেও অনেক কিছু এগোয়নি।’
নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগে আইনের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে ব্রাইট গ্রিন এনার্জি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান দীপাল চন্দ্র বড়ুয়া বলেন, ‘নবায়নযোগ্য জ্বালানি শক্তিকে সমৃদ্ধ করতে হলে দেশে একটি নবায়নযোগ্য জ্বালানি আইন প্রয়োজন। যে আইনের মাধ্যমে সরকার, জনগণ এবং এ খাত নিয়ে যারা কাজ করেন তারা সবাই এ আইন েনে চলতে বাধ্য থাকবেন।’
পিএসএল এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড গ্রিন এনার্জি লিমিটেডের পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নাছির উদ্দিন বলেন, ‘দেশে নেট মিটারিং পলিসি রয়েছে। ২০০৯ সালে এটি পরিপত্র হিসেবে প্রকাশ করা হয়। চাইলে পাঁচ মেগাওয়াটের নিচে ইউটিলিটিগুলোর বাণিজ্যিক ভিত্তিতে রুফটপ সোলার করার সুযোগ আছে। আমরা যারা ওপেক্স মডেলে বিনিয়োগ করতে চাই, তাদের ইউটিলিটি কোম্পানির সঙ্গে এ পলিসি নিয়ে কাজ করার সুযোগ আছে। অসুবিধাটা হচ্ছে, আমরা দুই বছর ধরে চেষ্টা করছি ইউটিলিটি কোম্পানির সঙ্গে ওপেক্স মডেলে কাজ করতে কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না।’
ফোরাম ফর এনার্জি রিপোর্টার্স বাংলাদেশের (এফইআরবি) নির্বাহী পরিচালক সেরাজুল ইসলাম সিরাজ বলেন, ‘ইডকল বা অন্যান্য যে প্রতিষ্ঠান সোলারের সেবা দিচ্ছে, সেখানে সাধারণ মানুষ আসতে চায় না। ঢাকায় এসে তারা সেবা নিতে চায় না। সাধারণ জনগণের কাছে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না হলে সোলারকে জনপ্রিয় করা কঠিন হবে এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হবে।’
ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইডকলের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও রিনিউয়েবল এনার্জি প্রজেক্টে রুফটপ সোলারের টিম লিডার মো. সিরাজুল হোসাইন। বণিক বার্তার প্রধান প্রতিবেদক বদরুল আলমের সঞ্চালনায় এতে আরো বক্তব্য দেন বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. জিয়াউর রহমান খান, স্রেডার সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও সদস্য সিদ্দিক জোবায়ের, ইডকলের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট (এনভায়রনমেন্ট সোশ্যাল সেফ গার্ড, আরই) ড. আহমেদুল হাই চৌধুরী, ইডকলের সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্স ভাইস প্রেসিডেন্ট ও রিনিউয়েবল এনার্জি প্রকল্পের প্রধান রাসেল আহমেদ, ইডকলের অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট (আরই) মো. আসাদুজ্জামান, ইডকলের টেকনিক্যাল ম্যানেজার রিয়াদ-বিন-শহীদ, সামুদা গ্রিন এনার্জির হেড অব অপারেশন পরিতোষ মজুমদার, রাইজিং গ্রুপের চিফ সাসটেইনেবিলিটির ম্যানেজার মুস্তাফিজুর রহমান ও ইডকলের জ্যেষ্ঠ করমকর্তা (কারিগরি) মাহমুদুর রহমান সায়েম।
বর্তমানে ১ হাজার কোটি টাকা রুপটফ সোলারে বিনিয়োগ হয়েছে। আরো তিন-পাঁচ হাজার মেগাওয়াট রুফটপ সোলারে বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। রুফটপ সোলার ব্যবহার বাড়াতে এ খাতের সুবিধা ও টেকসই বিনিয়োগের বিষয়ে প্রচারণামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা গেলে রুফটপ বিনিয়োগ বাড়বে। সেই সঙ্গে কারিগরি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা যাবে।
গতকাল ‘বাংলাদেশে রুফটপ সোলার সিস্টেম: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক ওয়েবিনার এসব কথা তুলে ধরেন অংশ নেয়া অতিথিরা।