দ্রব্যমূল্যের ধারাবাহিক ঊর্ধ্বগতিতে অস্বস্তিতে রয়েছে মানুষ। জীবনধারণে প্রয়োজনীয় সব ধরনের পণ্য ও সেবার পেছনে ব্যয় বেড়ে গেছে মাত্রাতিরিক্ত। এদিকে ব্যয় যত বাড়ছে, দেশে মূল্যস্ফীতির পারদও তত ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে সাধারণের আয় এবং জীবন-জীবিকায়। সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছে নিম্ন আয়ের মানুষ। এই বাস্তবতায় মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে নিম্ন আয়ের মানুষকে যতটা সম্ভব সুরক্ষা দেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। এজন্য আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ব্যয়ের আকার অন্তত ৭ হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হচ্ছে। বরাদ্দ বাড়ানো হলেও এবারের বাজেটে শেষ পর্যন্ত উপকারভোগীদের ভাতার হার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে সরকার। এর পরিবর্তে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর বিদ্যমান কর্মসূচির আওতায় বেশি করে উপকারভোগী বাড়ানো হচ্ছে। এতে এ দফায় বাজেটে প্রায় ২০ লাখ উপকারভোগী বাড়তে চলেছে।
অর্থ বিভাগ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অর্থ বিভাগের প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা ছিল জনগণের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে বাজেটে প্রয়োজনীয় সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের। বিশেষ করে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে ভাতার পরিমাণ বাড়াতে পারলে ভালো, তবে যতটা সম্ভব উপকারভোগীর আওতা বাড়িয়ে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বড় অংশকে পর্যায়ক্রমে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এর জন্য বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ যৌক্তিক উপায়ে বাড়াতে হবে। সরকারি ব্যয়ে প্রয়োজনীয় অর্থের জোগানে নানা ধরনের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে অর্থ বিভাগ থেকে সেভাবেই আসন্ন বাজেটে সরকারি ব্যয়ের হিসাব চূড়ান্ত করা হয়েছে। আগামী ৬ জুন জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করবেন। প্রস্তাবিত ওই বাজেটে তিনি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় প্রায় ৫ কোটি মানুষকে বছরব্যাপী নগদ ভাতা, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি অব্যাহত রাখা এবং সুলভমূল্যে খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিতে ১ লাখ ৩৩ হাজার ২৭২ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করবেন বলে জানা গেছে।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছর সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের ১৩০টি কর্মসূচির আওতায় বাজেটে ১ লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সেই হিসাবে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে এ ব্যয় ৭ হাজার কোটি টাকা বাড়ছে। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা। তারও আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তায় ব্যয় ধরা হয় ৯৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।
দেশে ১৪ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের উপরে অবস্থান করছে। বৈশ্বিক দীর্ঘমেয়াদি সংকট, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন সীমাবদ্ধতা, চাহিদাযোগ্য পণ্যের অতিমাত্রার আমদানিনির্ভরতা, ডলারের দাম লাগামহীন বৃদ্ধি এবং সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির বিরূপ প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে। এতে কমছে বিনিয়োগ, কমছে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ। অথচ ক্রমে বাড়ছে জীবনযাত্রার ব্যয়।
বিভিন্ন সংস্থার গবেষণা তথ্য বলছে, এ বাস্তবতায় তাল মেলাতে মানুষের হিমশিম দশা। আগের থেকে দেড়-দুইগুণ বেশি খরচ করেও মানুষকে চাহিদার সঙ্গে আপস করতে হচ্ছে। এসবের দীর্ঘমেয়াদি ধাক্কা অতি দারিদ্র্য ও দরিদ্র শ্রেণি তো বটেই; নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণিরও পারিবারিক-সামাজিক ভিত্তি দুর্বল থেকে দুর্বলতর পর্যায়ে পৌঁছেছে। দেশে এই যখন পরিস্থিতি, ঠিক সেই মুহূর্ত সামনে রেখে বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ে উপকারভোগীর আকার ও ব্যয় বৃদ্ধির সরকারি উদ্যোগকে বেশ ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বেসরকারি আর্থিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর কালবেলাকে বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপট এবং আগামীর শঙ্কা বিবেচনা করলে দেশের মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার মতো কার্যকর উদ্যোগ হতে পারে সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচির আওতা বাড়ানো। সেক্ষেত্রে অন্যান্য ব্যয় কিছুটা কাটছাঁট করে সরকারের উচিত হবে এই খাতে ব্যয় আরও বাড়ানো। সরকার যদি সেটি করে থাকে, তাহলে এ উদ্যোগে সঠিক পথেই রয়েছে। তবে যে অর্থ যে কর্মসূচিগুলোয় বরাদ্দ রাখা হবে, সেগুলো যাতে প্রকৃত উপকারভোগী পায়, তার ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা জরুরি।
এদিকে উপকারভোগীর আওতা বাড়ানোর উদ্যোগে বিভিন্ন ভাতা বা নগদ অর্থের আওতায় আসবে ১০ লাখ ২৬ হাজার ৮০০ জন। যারা সবাই অতিদরিদ্র। বাকি ১০ লাখ মানুষকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মুখে ওএমএসসহ বিভিন্ন খাদ্য সহায়তা কর্মসূচিতে যুক্ত করা হবে। এতে আগামী বাজেটে সব মিলে দেশে সরাসরি নগদ অর্থ তথা ভাতার আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে ১ কোটি ৩৮ লাখ ৭৩ হাজার জন। একইভাবে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, খাদ্য ভর্তুকি এবং টিসিবির ভর্তুকি মূল্যের কার্যক্রমের আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ৩ কোটি ৭২ লাখ ৯৭ হাজার জন। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছর এই দুই কর্মসূচিতে মোট সুবিধাভোগী রয়েছেন ৪ কোটি ৭১ লাখ ১৭ হাজার ২০০ জন। অর্থাৎ আগামী অর্থবছর সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর বিভিন্ন কর্মসূচিতে আরও ২০ লাখ ২৬ হাজার ৮০০ জন যুক্ত হচ্ছে।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপের মধ্যে বয়স্কভাতাভোগীর আওতা বাড়িয়ে নতুন যুক্ত করা হচ্ছে আরও ২ লাখ প্রবীণকে। সব মিলে আগামী অর্থবছর এই কর্মসূচির আওতায় ৬০ লাখ মানুষকে ভাতা সুবিধা দেওয়া হবে। তাদের ভাতা আগের মতো ৬০০ টাকাই বহাল থাকছে। এ ছাড়া বাড়ছে বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতাদের ক্ষেত্রে ভাতাভোগীর সংখ্যা। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, আগামী বাজেটে বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতাদের ভাতাভোগীর সংখ্যা বাড়ছে ২ লাখ ৬০ হাজার ৮০০ জন। এই হিসাবে আগামী অর্থবছর এ কর্মসূচিতে মোট সুবিধা পাবেন ২৭ লাখ ৭৫ হাজার জন। তাদের ভাতার পরিমাণ চলতি বছরের মতো ৫৫০ টাকাই অপরিবর্তিত থাকছে। মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচির ক্ষেত্রে ভাতার পরিমাণ আগের মতোই রেখে নতুন করে উপকারভোগী বাড়ানো হচ্ছে আরও ২ লাখ ৬০ হাজার ৮০০ জন। বর্তমানে ১৩ লাখ ৪ জন এ সুবিধা পাচ্ছেন। এর ফলে আগামী বাজেটের মাধ্যমে এ কর্মসূচিতে সরাসরি ভাতা সহায়তা পাবেন ১৫ লাখ ৬৪ হাজার মা ও শিশু। এ ছাড়া প্রতিবন্ধী ভাতাভোগীও বাড়ছে। আগামী বাজেটে এ সংখ্যা ৩ লাখ ৩৪ হাজার জন বাড়িয়ে মোট ৩২ লাখ ৩৪ হাজার জনে উন্নীত করা হচ্ছে। এ ছাড়া হিজড়া, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর আওতা ১২ হাজার ২২৯ জন নতুন করে আগামী বাজেটের মাধ্যমে ভাতা সুবিধার আওতায় ভিড়ছে। সব মিলে এই খাতে সরকার আগামী অর্থবছর থেকে ৭৭ হাজার ২২৯ জনকে বর্তমান হারে ভাতা প্রদান করবে।