আধুনিক বিশ্বের সাথে খাপ খাওয়াতে হলে ইন্টারনেট কিংবা স্মার্টফোনকে বাদ দেওয়ার কোন উপায় নেই। কিন্তু বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে স্মার্টফোন কতটা সুফল এনে দিচ্ছে সেটা ভাবার সময় এসেছে।
কিছুদিন আগে আমি বিকেলবেলা বন্ধুদের সাথে হাঁটতে বেরিয়েছি। হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার পাশে কিছু অনূর্ধ্ব আঠারো বয়সের ছেলে আমার চোখে পড়ল। ওদের মধ্য থেকে শব্দ আসছিল ‘মামা, মার মার। এবার ধর’ আমি শব্দটা শুনে থেমে গেলাম এবং আমার সাথে থাকা বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম যে, শব্দটা ওদের কাছ থেকে আসলো না? ও বলল, ‘হ্যাঁ, ওখান থেকেই এসেছে, ওরা ফ্রি ফায়ার খেলছে।
আমি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। গ্রামের এই ফ্রি ফায়ার খেলার সংখ্যাটা ষোল কিংবা আঠারো অনূর্ধ্ব বেশিরভাগই। এদের অনেকের পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব শোচনীয়। কারো পরিবারে খাবারই ঠিক মতো জুটে না। অধিকাংশ ছেলেরা অনলাইন ক্লাসের দোহাই দিয়ে স্মার্টফোন কিনেছে। কিংবা কেউ কেউ পরিবারের চোখ ফাঁকি দিয়ে স্মার্টফোন কিনেছে। কিন্তু সবার আসল উদ্দেশ্য ফ্রি ফায়ার খেলা। আজ থেকে ঠিক দশ বছর আগের কথা যদি চিন্তা করি তবে দেখা যাবে তখন স্মার্টফোন এতটা সহজলভ্য ছিল না আর অনলাইনভিত্তিক গেমসও তেমন ছিল না। কিন্তু এখন স্মার্টফোন খুব সহজলভ্য। এমন অবস্থা হয়েছে, সদ্য জন্ম নেওয়া বাচ্চার কান্নাও বন্ধ হচ্ছে মোবাইল দেখে।
বর্তমান তরুণ প্রজন্মের কাছে ফ্রি ফায়ার মাদকের চেয়ে অনেকাংশে বড় নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাদক সেবা করতে বেগ পেতে হয়, লোকজনের চোখ ফাঁকি দিয়ে সেবন করতে হয়। ফ্রি ফায়ার খেলায় ওতটা বেগ পেতে হয় না। এটা নিয়ে মন্তব্য করারও সুযোগ থাকে না। ফ্রি ফায়ার বর্তমানে সংক্রামক হয়ে দাঁড়িয়েছে। একজন খেললে তার আশেপাশের সমবয়সী সবাইকে প্রভাবিত করছে। এটা শুধু যে গ্রামের ছেলেরা খেলছে তা নয়। শহরের অলিতে গলিতে পাবজি খেলার আসর বসায় ছেলেরা। যেহেতু খেলাটা ইন্টারনেট ছাড়া খেলা যায় না। এখানে প্রতিদিন টাকা খরচ করে ডাটা কিনতে হয় আবার টাকা দিয়ে বিকাশের মাধ্যমে ডলার কিনে তা দিয়ে খেলার সামগ্রী অনলাইনে কিনতে হয়। যার মাধ্যমে শুধু আর্থিক ক্ষতিই হচ্ছে না বরং তরুণ প্রজন্ম নিজেদের মানসিক ও শারীরিক ক্ষতি করছে।
দীর্ঘদিন খেলার ফলে চোখের সমস্যা, মাথা ব্যথা ও ঘাড়ে ব্যথা হতে পারে। সবচেয়ে যে বিষয়টি ভাবার সেটা হচ্ছে অপরাধ প্রবণতা। যখন ষোল বছরের ছেলেটা পরিবারের কাছ থেকে টাকা পায় না মোবাইল ডাটা কিংবা ডলার ক্রয়ের জন্য তখন ছেলেটা চুরি কিংবা ছিনতাইয়ের মতো অপরাধের সাথে যুক্ত হতে একটুও চিন্তা করে না। একে তো করোনার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। তাই এই সময়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আঠারো অনূর্ধ্বরা। তারা নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি ডেকে আনছে। এখানে পরিবারের সদস্যদের বিশেষ করে মা-বাবাকে সচেতন হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। অন্যথায় পরবর্তীতে ব্যাপক হুমকির সম্মুখীন হতে হবে।
বিপর্যস্ত হতে পারে তরুণ প্রজন্ম। পরিবারের বাবা চাকরি করলে মা’কে তার সন্তানকে বেশি বেশি সময় দিতে হবে। কারণ আসক্তি সে যে বিষয়ে হোক না কেন খুব খারাপ। যেটা থেকে বের হয়ে আসা খুব কঠিন।
রাসেল ব্রান্ড (Russell Brand) বলেছেন, ‘নেশা হলো এক মারাত্মক ব্যাধি যার ইতি টানতে হলে আপনাকে হাসপাতাল কিংবা জেলে যেতেও হতে পারে।’ তাই এই ফ্রি ফায়ার নেশার আসক্তি থেকে বাঁচাতে হলে পরিবারের সদস্যদের সচেতনতার বিকল্প নেই।
ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ সরকার ওয়েবসাইটে পর্নোগ্রাফি বন্ধ করে দিয়েছেন। এটা নিশ্চয়ই প্রশংসার যোগ্য। এটার মতো করে ফ্রি ফায়ারসহ সকল অনলাইন খেলা বন্ধ করে দেওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
যেহেতু এটা একটা গ্রুপ গেম, একসাথে অনেকে মিলে খেলতে পারে। তাই এর দ্বারা ক্ষতিটাও খুব বেশি হচ্ছে। নিজেদের অতিরিক্ত আধুনিক ভেবে ভেবে সমাজের কেউ কেউ ছেলেমেয়ের হাতে স্মার্টফোন তুলে দিচ্ছে। কিন্তু আসলে তারা স্মার্টফোন দিয়ে কী করছে তার খোঁজ নিচ্ছে না।
অনলাইন ক্লাস করতে গিয়ে সে কী করছে অনলাইনে, কোনো গেম খেলছে কি না এই বিষয়ে খুব সচেতন হওয়া উচিত। অন্যথায় এর ভয়ঙ্কর পরিণাম ভোগ করতে হবে তাদেরকেই। টাকার অভাবে যখন তরুণদের ফ্রি ফায়ার খেলা বন্ধ হয়ে যায় তখন টাকা উপার্জনের জন্য তারা গ্রুপিং করে অপরাধ শুরু করে। জড়িয়ে যায় নানা ঘৃণিত অপরাধের সাথে। আবার কেউ কেউ স্মার্টফোন না পেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে।