Dhaka 8:24 pm, Sunday, 22 December 2024

অফশোর ব্যাংকিংয়ে গতি পাবে বিদেশী বিনিয়োগ: বাড়বে রেমিটেন্স

 

অফশোর ব্যাংকিং হলো ব্যাংকের ভেতরেই পৃথক ব্যাংকিং সেবা। বিষয়টি আরও সহজ করে বললে, আমানত গ্রহণ ও ঋণ দেওয়ার দুই কার্যক্রমই বৈদেশিক উৎস থেকে আসে ও বিদেশী গ্রাহকদের দেওয়া হয়। অর্থাৎ, এই ব্যাংকিং কার্যক্রম শুধু অনিবাসীদের মধ্যেই সীমিত থাকে।

স্থানীয় মুদ্রার পরিবর্তে বৈদেশিক মুদ্রায় হিসাব হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা মেনে দেশের অনেক ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরেই অফশোর ব্যাংকিং করে আসছে, তবে এ সংক্রান্ত কোনো আইন এতদিন ছিল না। গত ৫ মার্চ জাতীয় সংসদে অফশোর ব্যাংকিং আইন-২০২৪ পাস হয়েছে। নতুন আইনে বলা হয়েছেÑ বিদেশে যে বাংলাদেশী বসবাস করছেন, তার পক্ষে দেশে অবস্থানরত যেকোনো বাংলাদেশী নাগরিক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবেন। সহায়তাকারী হিসেবে তারা অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করতে পারবেন। অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে পাঁচ ধরনের বিদেশী মুদ্রাÑ ডলার, পাউন্ড, ইউরো, জাপানি ইয়েন ও চীনা ইউয়ানে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে অন্য বিদেশী মুদ্রায়ও লেনদেনের সুযোগ পাবে ব্যাংকগুলো। অফশোর ব্যাংকিং ব্যবসায় অর্জিত সুদ বা মুনাফার ওপর আয়কর বা অন্য কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কর আরোপ করা যাবে না। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বৃদ্ধি, রিজার্ভ ও এলসি খোলার সংকটের সমাধানসহ বিদেশী বিনিয়োগ আরও উৎসাহিত হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

জানা গেছে, বাংলাদেশে ১৯৮৫ সালে অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনের ভিত্তিতে সে সময় কাজ শুরু হয়েছিল। ২০১৯ সালে অফশোর ব্যাংকিং নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি অফশোর ব্যাংকিং আইন-২০২৪ এর খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এরপর গত ৫ মার্চ জাতীয় সংসদে অফশোর ব্যাংকিং আইন পাস হয়। মঙ্গলবার অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী অফশোর ব্যাংকিং বিল-২০২৪ পাসের জন্য উত্থাপন করেন। জনমত যাচাই-বাছাই কমিটিতে প্রেরণ ও সংশোধনী প্রস্তাব নিষ্পত্তি শেষে বিলটি কণ্ঠভোটে পাস হয়। এর আগে বিলের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির কয়েকজন সদস্য জানান, অফশোর ব্যাংকিং সম্পর্কে এমপিদের ধারণা নেই। ধারণা যা আছে, তা নেতিবাচক। তারা মনে করেন, অফশোর ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে অর্থ পাচারের সম্পর্ক রয়েছে। এ বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান জনকণ্ঠকে বলেন, ‘নতুন আইনের মাধ্যমে পাচারপ্রবণতা বাড়বেÑ এমনটা আমি মনে করি না। বরং আইনে ট্যাক্স মওকুফসহ বেশ কিছু সুবিধা যুক্ত হয়েছে, যা দেশে বৈদেশিক মুদ্রাপ্রবাহ বাড়াতে সহায়ক হবে।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের রিজার্ভ চাপে রয়েছে, বাজারে ডলার সংকট আছে। তাই অফশোর ব্যাংকিংয়ে সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে ডলার সংকট নিরসনে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।’

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘যেহেতু আইনে নতুন কিছু নেই, তাই এর মাধ্যমে অর্থ পাচার বাড়ার কোনো কারণ নাই, বরং এর মাধ্যমে অফশোর ব্যাংকিংয়ের আইনি ভিত্তি তৈরি হয়েছে। যা বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াবে।’ তিনি বলেন, ‘এই আইনের মাধ্যমে হিসাব পরিচালনা, ট্যাক্স আরোপ না করাসহ অনেক জটিলতা দূর হয়েছে। ঋণ দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে ট্রেড ফাইন্যান্স পুরোপুরি উন্মুক্ত করা হয়েছে। ফলে অনেক স্বস্তির পরিবেশ তৈরি হয়েছে।’

অফশোর ব্যাংকিংয়ের আইনি ভিত্তি তৈরির পেছনে রিজার্ভ বৃদ্ধির উদ্দেশ্য রয়েছে সরকারের। আইনটি মন্ত্রিসভা অনুমোদন দেওয়ার পর বিষয়টি স্পষ্ট করেছিলেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন। তিনি বলেন, ‘এই আইন  প্রণয়ন হচ্ছে শুধু দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী করার জন্য। এই পদ্ধতি অনুসরণ করে অনেক দেশ তাদের বৈদেশিক রিজার্ভ ও আর্থিক কাঠামো সমৃদ্ধ করেছে। তারা বিলিয়ন ডলার ইনভেস্টমেন্ট পেয়েছে।’ খসড়ায় বলা হয়েছেÑ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে লাইসেন্স নিতে হবে। শুধুমাত্র লাইসেন্সধারী ব্যাংকগুলোতে অফশোর অ্যাকাউন্ট খোলা যাবে। যাদের লাইসেন্স আছে, তাদের নতুন করে নিতে হবে না। বাংলাদেশে বর্তমানে ৩৯টি ব্যাংক অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ ধরনের ব্যাংকিং কার্যক্রমে যারা বিনিয়োগ করবে, তারা বিদেশী বা অনিবাসী কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হতে হবে। অনুমোদিত এই আইনের অধীনে ব্যাংকগুলো বিদেশী বা অনিবাসী কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় যে আমানত গ্রহণ করবে, তা স্বাভাবিক ব্যাংকিং পদ্ধতিতে ব্যবহার করতে পারবে।

বর্তমানে যে অফশোর ব্যাংকিং ব্যবস্থা রয়েছে, তাতে ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (টিআইএন) না থাকলে আমানতের আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ কর দিতে হয়। আর টিআইএন থাকলে ১০ শতাংশ কর দিতে হয়। নতুন আইনে কোনো কর দিতে হবে না। একই সঙ্গে অফশোর ব্যাংকিং লেনদেনে যে সুদ আসবে, তার ওপর কোনো কর আরোপ করা হবে না। অ্যাকাউন্ট পরিচালনার জন্য কোনো সুদ বা চার্জ দিতে হবে না। অনুমোদিত নতুন আইনে কোনো ঋণসীমা রাখা হয়নি, এতে যে কোনো পরিমাণ লেনদেন করা যাবে। বর্তমানে বাংলাদেশে ইপিজেডে যে অফশোর অ্যাকাউন্ট রয়েছে, তা কারেন্ট অ্যাকাউন্ট। এসব অ্যাকাউন্টে কোনো লাভ দেওয়া হয় না। তবে, নতুন আইনে অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রমে লাভ দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা এ আইনের বিষয়ে বলেন, কর অব্যাহতি না থাকার কারণে এতদিন এইচএসবিসি ঢাকার ফান্ডিংও হতো এইচএসবিসি হংকং থেকে।

কারণ সেখানে অর্থায়নের ওপর কর নেই। আমরা এ ধরনের কর অব্যাহতির সুযোগ ব্যাংকগুলোকে দিতে পারছিলাম না, কারণ আয়কর আইনে ব্যাংকগুলোকে এই ছাড় দেওয়ার সুযোগ ছিল না। এখন আইনটি পাস হওয়ায় ইবিএল, ঢাকা ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের মতো স্থানীয় ব্যাংকগুলো নিশ্চিতে অফশোর ব্যাংকিংয়ের আওতায় অর্থায়ন করতে পারবে। এ ছাড়া অন্য সব সুবিধাই আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালার আওতায় ব্যাংকগুলোকে দিয়েছিলাম। তারপরও তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে ছিল কর ছাড় না থাকার কারণে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী অফশোর ব্যাংকিংয়ের আওতায় সংগৃহীত আমানতের ওপর প্রচলিত ধারার ব্যাংকিংয়ের মতো নগদ জমা (সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ জমার (এসএলআর) বাধ্যবাধকতা ছিল। নতুন আইনে সে বিষয়ে অব্যাহতি দেওয়া হবে ব্যাংকগুলোকে। এর ফলে তাদের আমানতের পুরোটাই বিনিয়োগ করতে পারবে। এতে অফশোর ব্যাংকিংয়ের তহবিল আগের থেকে বাড়বে।

ব্যাংকাররা বলছেন, এই ব্যাংকিং পদ্ধতিতে অসুবিধার চেয়ে সুবিধাই বেশি। এই ব্যাংকিংয়ে যে কোনো কোম্পানি বা ব্যক্তি দেশ-বিদেশে সহজ শর্তে ব্যবসা করতে পারবে। অনুমোদিত নতুন আইনের আওতায় সরকার এই ব্যাংকিং কার্যক্রমে আকর্ষণীয় সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে। প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার সঙ্গে এর পার্থক্য হলো এতে বিধিনিষেধ একেবারেই কম। গ্রাহকের তথ্যসংক্রান্ত চূড়ান্ত গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়। তবে অসুবিধাও রয়েছে বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা। জানতে চাইলে মেঘনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল আমিন বলেন, অতীতে এমন উদাহরণও রয়েছেÑ অফশোরের মাধ্যমে বিদেশ থেকে লোন নিয়ে দেশে ব্যবসা করছে, দেশে লোন শোধ করছে। এ ক্ষেত্রে তার এক্সপোর্ট সেভাবে না থাকলে ওই লোন শোধ হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। তার মানে তাকে উল্টা করে লোকাল টাকা দিয়ে লোন শোধ করার সুযোগ নেই। পর্যাপ্ত এক্সপোর্টের মাধ্যমে কভার না করলে ওই লোন পরিশোধ কঠিন হয়ে পড়ে। এ সমস্যা রোধে তদারকি করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন সাবেক এই ব্যাংকার। তিনি বলেন, যে কারণে লোন দেওয়া হচ্ছে, সেটা পালন হচ্ছে কি না, সেটা মনিটরিং জরুরি। তিনি আরও বলেন, এই কার্যক্রমের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো দেশে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়বে। কারণ যারা এতে অংশ নেবে তাদের সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের রেস্ট্রিকশন কম থাকবে। কারণ ফরেন কারেন্সির ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ অনেক উদার করা হয়েছে।

অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশে অফশোর ব্যাংকিং কিন্তু নতুন নয়। এতদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার আলোকে এটা হতো। এখন সেটাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে; এটাকে আমি অবশ্যই ভালো উদ্যোগ বলে মনে করি। এটা ভালোভাবে কাজ করলে বেসরকারি খাতের পাশাপাশি সরকারি খাতেও বিনিয়োগ আসবে। রিজার্ভ বাড়বে।

ট্যাগস :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয়
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com

অফশোর ব্যাংকিংয়ে গতি পাবে বিদেশী বিনিয়োগ: বাড়বে রেমিটেন্স

আপলোড সময় : 09:20:50 pm, Saturday, 9 March 2024

 

অফশোর ব্যাংকিং হলো ব্যাংকের ভেতরেই পৃথক ব্যাংকিং সেবা। বিষয়টি আরও সহজ করে বললে, আমানত গ্রহণ ও ঋণ দেওয়ার দুই কার্যক্রমই বৈদেশিক উৎস থেকে আসে ও বিদেশী গ্রাহকদের দেওয়া হয়। অর্থাৎ, এই ব্যাংকিং কার্যক্রম শুধু অনিবাসীদের মধ্যেই সীমিত থাকে।

স্থানীয় মুদ্রার পরিবর্তে বৈদেশিক মুদ্রায় হিসাব হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা মেনে দেশের অনেক ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরেই অফশোর ব্যাংকিং করে আসছে, তবে এ সংক্রান্ত কোনো আইন এতদিন ছিল না। গত ৫ মার্চ জাতীয় সংসদে অফশোর ব্যাংকিং আইন-২০২৪ পাস হয়েছে। নতুন আইনে বলা হয়েছেÑ বিদেশে যে বাংলাদেশী বসবাস করছেন, তার পক্ষে দেশে অবস্থানরত যেকোনো বাংলাদেশী নাগরিক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবেন। সহায়তাকারী হিসেবে তারা অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করতে পারবেন। অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে পাঁচ ধরনের বিদেশী মুদ্রাÑ ডলার, পাউন্ড, ইউরো, জাপানি ইয়েন ও চীনা ইউয়ানে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে অন্য বিদেশী মুদ্রায়ও লেনদেনের সুযোগ পাবে ব্যাংকগুলো। অফশোর ব্যাংকিং ব্যবসায় অর্জিত সুদ বা মুনাফার ওপর আয়কর বা অন্য কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কর আরোপ করা যাবে না। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বৃদ্ধি, রিজার্ভ ও এলসি খোলার সংকটের সমাধানসহ বিদেশী বিনিয়োগ আরও উৎসাহিত হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

জানা গেছে, বাংলাদেশে ১৯৮৫ সালে অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনের ভিত্তিতে সে সময় কাজ শুরু হয়েছিল। ২০১৯ সালে অফশোর ব্যাংকিং নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি অফশোর ব্যাংকিং আইন-২০২৪ এর খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এরপর গত ৫ মার্চ জাতীয় সংসদে অফশোর ব্যাংকিং আইন পাস হয়। মঙ্গলবার অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী অফশোর ব্যাংকিং বিল-২০২৪ পাসের জন্য উত্থাপন করেন। জনমত যাচাই-বাছাই কমিটিতে প্রেরণ ও সংশোধনী প্রস্তাব নিষ্পত্তি শেষে বিলটি কণ্ঠভোটে পাস হয়। এর আগে বিলের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির কয়েকজন সদস্য জানান, অফশোর ব্যাংকিং সম্পর্কে এমপিদের ধারণা নেই। ধারণা যা আছে, তা নেতিবাচক। তারা মনে করেন, অফশোর ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে অর্থ পাচারের সম্পর্ক রয়েছে। এ বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান জনকণ্ঠকে বলেন, ‘নতুন আইনের মাধ্যমে পাচারপ্রবণতা বাড়বেÑ এমনটা আমি মনে করি না। বরং আইনে ট্যাক্স মওকুফসহ বেশ কিছু সুবিধা যুক্ত হয়েছে, যা দেশে বৈদেশিক মুদ্রাপ্রবাহ বাড়াতে সহায়ক হবে।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের রিজার্ভ চাপে রয়েছে, বাজারে ডলার সংকট আছে। তাই অফশোর ব্যাংকিংয়ে সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে ডলার সংকট নিরসনে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।’

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘যেহেতু আইনে নতুন কিছু নেই, তাই এর মাধ্যমে অর্থ পাচার বাড়ার কোনো কারণ নাই, বরং এর মাধ্যমে অফশোর ব্যাংকিংয়ের আইনি ভিত্তি তৈরি হয়েছে। যা বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াবে।’ তিনি বলেন, ‘এই আইনের মাধ্যমে হিসাব পরিচালনা, ট্যাক্স আরোপ না করাসহ অনেক জটিলতা দূর হয়েছে। ঋণ দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে ট্রেড ফাইন্যান্স পুরোপুরি উন্মুক্ত করা হয়েছে। ফলে অনেক স্বস্তির পরিবেশ তৈরি হয়েছে।’

অফশোর ব্যাংকিংয়ের আইনি ভিত্তি তৈরির পেছনে রিজার্ভ বৃদ্ধির উদ্দেশ্য রয়েছে সরকারের। আইনটি মন্ত্রিসভা অনুমোদন দেওয়ার পর বিষয়টি স্পষ্ট করেছিলেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন। তিনি বলেন, ‘এই আইন  প্রণয়ন হচ্ছে শুধু দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী করার জন্য। এই পদ্ধতি অনুসরণ করে অনেক দেশ তাদের বৈদেশিক রিজার্ভ ও আর্থিক কাঠামো সমৃদ্ধ করেছে। তারা বিলিয়ন ডলার ইনভেস্টমেন্ট পেয়েছে।’ খসড়ায় বলা হয়েছেÑ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে লাইসেন্স নিতে হবে। শুধুমাত্র লাইসেন্সধারী ব্যাংকগুলোতে অফশোর অ্যাকাউন্ট খোলা যাবে। যাদের লাইসেন্স আছে, তাদের নতুন করে নিতে হবে না। বাংলাদেশে বর্তমানে ৩৯টি ব্যাংক অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ ধরনের ব্যাংকিং কার্যক্রমে যারা বিনিয়োগ করবে, তারা বিদেশী বা অনিবাসী কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হতে হবে। অনুমোদিত এই আইনের অধীনে ব্যাংকগুলো বিদেশী বা অনিবাসী কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় যে আমানত গ্রহণ করবে, তা স্বাভাবিক ব্যাংকিং পদ্ধতিতে ব্যবহার করতে পারবে।

বর্তমানে যে অফশোর ব্যাংকিং ব্যবস্থা রয়েছে, তাতে ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (টিআইএন) না থাকলে আমানতের আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ কর দিতে হয়। আর টিআইএন থাকলে ১০ শতাংশ কর দিতে হয়। নতুন আইনে কোনো কর দিতে হবে না। একই সঙ্গে অফশোর ব্যাংকিং লেনদেনে যে সুদ আসবে, তার ওপর কোনো কর আরোপ করা হবে না। অ্যাকাউন্ট পরিচালনার জন্য কোনো সুদ বা চার্জ দিতে হবে না। অনুমোদিত নতুন আইনে কোনো ঋণসীমা রাখা হয়নি, এতে যে কোনো পরিমাণ লেনদেন করা যাবে। বর্তমানে বাংলাদেশে ইপিজেডে যে অফশোর অ্যাকাউন্ট রয়েছে, তা কারেন্ট অ্যাকাউন্ট। এসব অ্যাকাউন্টে কোনো লাভ দেওয়া হয় না। তবে, নতুন আইনে অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রমে লাভ দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা এ আইনের বিষয়ে বলেন, কর অব্যাহতি না থাকার কারণে এতদিন এইচএসবিসি ঢাকার ফান্ডিংও হতো এইচএসবিসি হংকং থেকে।

কারণ সেখানে অর্থায়নের ওপর কর নেই। আমরা এ ধরনের কর অব্যাহতির সুযোগ ব্যাংকগুলোকে দিতে পারছিলাম না, কারণ আয়কর আইনে ব্যাংকগুলোকে এই ছাড় দেওয়ার সুযোগ ছিল না। এখন আইনটি পাস হওয়ায় ইবিএল, ঢাকা ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের মতো স্থানীয় ব্যাংকগুলো নিশ্চিতে অফশোর ব্যাংকিংয়ের আওতায় অর্থায়ন করতে পারবে। এ ছাড়া অন্য সব সুবিধাই আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালার আওতায় ব্যাংকগুলোকে দিয়েছিলাম। তারপরও তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে ছিল কর ছাড় না থাকার কারণে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী অফশোর ব্যাংকিংয়ের আওতায় সংগৃহীত আমানতের ওপর প্রচলিত ধারার ব্যাংকিংয়ের মতো নগদ জমা (সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ জমার (এসএলআর) বাধ্যবাধকতা ছিল। নতুন আইনে সে বিষয়ে অব্যাহতি দেওয়া হবে ব্যাংকগুলোকে। এর ফলে তাদের আমানতের পুরোটাই বিনিয়োগ করতে পারবে। এতে অফশোর ব্যাংকিংয়ের তহবিল আগের থেকে বাড়বে।

ব্যাংকাররা বলছেন, এই ব্যাংকিং পদ্ধতিতে অসুবিধার চেয়ে সুবিধাই বেশি। এই ব্যাংকিংয়ে যে কোনো কোম্পানি বা ব্যক্তি দেশ-বিদেশে সহজ শর্তে ব্যবসা করতে পারবে। অনুমোদিত নতুন আইনের আওতায় সরকার এই ব্যাংকিং কার্যক্রমে আকর্ষণীয় সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে। প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার সঙ্গে এর পার্থক্য হলো এতে বিধিনিষেধ একেবারেই কম। গ্রাহকের তথ্যসংক্রান্ত চূড়ান্ত গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়। তবে অসুবিধাও রয়েছে বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা। জানতে চাইলে মেঘনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল আমিন বলেন, অতীতে এমন উদাহরণও রয়েছেÑ অফশোরের মাধ্যমে বিদেশ থেকে লোন নিয়ে দেশে ব্যবসা করছে, দেশে লোন শোধ করছে। এ ক্ষেত্রে তার এক্সপোর্ট সেভাবে না থাকলে ওই লোন শোধ হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। তার মানে তাকে উল্টা করে লোকাল টাকা দিয়ে লোন শোধ করার সুযোগ নেই। পর্যাপ্ত এক্সপোর্টের মাধ্যমে কভার না করলে ওই লোন পরিশোধ কঠিন হয়ে পড়ে। এ সমস্যা রোধে তদারকি করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন সাবেক এই ব্যাংকার। তিনি বলেন, যে কারণে লোন দেওয়া হচ্ছে, সেটা পালন হচ্ছে কি না, সেটা মনিটরিং জরুরি। তিনি আরও বলেন, এই কার্যক্রমের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো দেশে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়বে। কারণ যারা এতে অংশ নেবে তাদের সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের রেস্ট্রিকশন কম থাকবে। কারণ ফরেন কারেন্সির ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ অনেক উদার করা হয়েছে।

অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশে অফশোর ব্যাংকিং কিন্তু নতুন নয়। এতদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার আলোকে এটা হতো। এখন সেটাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে; এটাকে আমি অবশ্যই ভালো উদ্যোগ বলে মনে করি। এটা ভালোভাবে কাজ করলে বেসরকারি খাতের পাশাপাশি সরকারি খাতেও বিনিয়োগ আসবে। রিজার্ভ বাড়বে।