সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস কাতারের আমিরের
বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা জোরদার করতে মঙ্গলবার দুই দেশের মধ্যে পাঁচটি চুক্তি ও পাঁচটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে। বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে আয়ের ক্ষেত্রে দ্বৈত কর পরিহার এবং রাজস্ব ফাঁকি প্রতিরোধ, আইনি ক্ষেত্রে সহযোগিতা, সমুদ্র পরিবহন, পারস্পরিক বিনিয়োগ প্রচার ও সুরক্ষা এবং যৌথ ব্যবসায়িক পরিষদ প্রতিষ্ঠার বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষর হয়।
চুক্তি ছাড়াও পাঁচটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে, জনশক্তি কর্মসংস্থান (শ্রম) ক্ষেত্রে সহযোগিতা, বন্দর ক্ষেত্রে সহযোগিতা (এমডব্লিউএএনআই কাতার এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ), বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে সহযোগিতা, যুব ও ক্রীড়া ক্ষেত্রে সহযোগিতা এবং বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে কূটনৈতিক প্রশিক্ষণে সহযোগিতা।
মঙ্গলবার বাংলাদেশে সফররত কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে (পিএমও) অনুষ্ঠিত চুক্তি স্বাক্ষর প্রত্যক্ষ করেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পৌঁছালে শেখ হাসিনা আমিরকে টাইগার গেটে ফুলের তোড়া দিয়ে স্বাগত জানান। তাঁরা সেখানে একান্ত বৈঠকেও মিলিত হন। পরে দুই নেতা পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন।
কাতারের আমিরের এই সফরের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। আমিরের এ সফর দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বলেও মনে করছেন অভিজ্ঞ কূটনীতিকরা। তাঁদের মতে, আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির এই সফর বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে বহুমুখী অংশীদারিত্বকে আরও জোরদার করার উপায় নির্ধারণ করবে।
পিএমও ত্যাগের আগে কাতারের আমির টাইগার গেটে রক্ষিত দর্শনার্থী বইয়ে স্বাক্ষর করেন। এরপর তিনি পিএমও ত্যাগ করে বঙ্গভবনে যান যেখানে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন কাতারের আমিরের সম্মানে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করেন। বাংলাদেশ থেকে আরও দক্ষ ও আধা দক্ষ কর্মী নিতে কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানিকে অনুরোধ করেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।
মঙ্গলবার বিকেলে আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি একটি বিশেষ বিমানে নেপালের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ আমন্ত্রণে কাতারের আমির সোমবার দুদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকা আসেন।
যে পাঁচটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো ॥ কাতারের বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন হামাদ আল থানি এবং বাংলাদেশের শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক বিনিয়োগ উন্নয়ন ও সুরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে আয়ের ক্ষেত্রে দ্বৈত কর পরিহার এবং রাজস্ব ফাঁকি প্রতিরোধ চুক্তিটি স্বাক্ষর করেন কাতারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সুলতান বিন সাদ আল মুরাইখি এবং বাংলাদেশের অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান।
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক এবং কাতারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও কাতার রাষ্ট্রের মধ্যে আইনি ক্ষেত্রে সহযোগিতার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। কাতার ও বাংলাদেশের মধ্যে সামুদ্রিক পরিবহন সংক্রান্ত চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন কাতারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।
কাতার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (কিউসিসিআই) চেয়ারম্যান শেখ খলিফা বিন জসিম আল থানি এবং ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম বাংলাদেশ কাতার জয়েন্ট বিজনেস কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
পাঁচটি সমঝোতা স্মারক ॥ বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে কূটনৈতিক প্রশিক্ষণে সহযোগিতা সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এবং কাতারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সুলতান বিন সাদ আল মুরাইখি স্বাক্ষর করেন। পাশাপাশি তারা দুই দেশের মধ্যে শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয়ে সমঝোতা স্মারকেও স্বাক্ষর করেন।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী এবং কাতারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জনশক্তি কর্মসংস্থান (শ্রম) ক্ষেত্রে সহযোগিতা সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারকে সই করেন। বন্দর ক্ষেত্রে সহযোগিতায় (এমডব্লিউএএনআই কাতার এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ) কাতারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সুলতান বিন সাদ আল মুরাইখি এবং নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী স্বাক্ষর করেছেন।
অধিক শ্রমিক নিতে আমিরকে রাষ্ট্রপতির অনুরোধ ॥ বাংলাদেশ থেকে আরও দক্ষ ও আধা দক্ষ কর্মী নিতে কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানিকে অনুরোধ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। একইসঙ্গে বাংলাদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে কাতারের বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগেরও আহ্বান জানান তিনি।
মঙ্গলবার বঙ্গভবনে ঢাকা সফররত কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির সঙ্গে সাক্ষাৎকালে রাষ্ট্রপতি এ আহ্বান জানান। রাষ্ট্রপ্রধান খাদ্য সরবরাহের চেইনগুলো-উৎপাদন থেকে ব্যবহার পর্যন্ত-কৃষি-উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণ, খাদ্য প্যাকেজিং, স্মার্ট এগ্রিকালচার, সার উৎপাদনসহ বিভিন্ন খাতে ও বিনিয়োগকে স্বাগত জানাবে বাংলাদেশ।
উপসাগরীয় অঞ্চলে কাতারকে বাংলাদেশের একটি মূল্যবান উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, আমিরের সফর এবং দুই দেশের মধ্যে সম্পাদিত ১০টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) আগামী দিনে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতাকে আরও সম্প্রসারিত ও গভীরতর করবে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, বাংলাদেশ সরকার বিদেশী বিনিয়োগের জন্য ১শ’টি অর্থনৈতিক বিশেষ অঞ্চল স্থাপন করেছে। কাতারের বিনিয়োগকারীরা পেট্রো-কেমিক্যাল, জ্বালানি, মেশিনারিজ, তথ্য-প্রযুক্তি, ইলেক্ট্রনিক্স, সিরামিক, কৃষি-ব্যবসা, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের মতো কিছু ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রণোদনা পেতে পারে এবং সহায়তা করতে পারে।
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন প্রায় ৩ লাখ ৭৫ হাজার বাংলাদেশীকে কর্মসংস্থানের সুযোগ দেওয়ার জন্য কাতার সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, এই জনবল কাতার এবং বাংলাদেশ উভয় দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে প্রতিনিয়তই অবদান রাখছে। কাতারের আমিরকে আরও তরুণ, দক্ষ ও আধা-দক্ষ জনশক্তি, আইটি বিশেষজ্ঞ, পেশাদার প্রযুক্তিবিদ নিয়োগের আহ্বান জানান রাষ্ট্রপতি।
বাংলাদেশকে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) দেওয়ার জন্য কাতার সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে রাষ্ট্রপতি কাতারের কাছে দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি সহায়তা চেয়েছেন। তিনি বলেন, বাণিজ্য ও ব্যবসায়িক সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে উভয় পক্ষকে আরও বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। রাষ্ট্রপতি চলমান ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে আলোচনার সুবিধার্থে কাতারের (মিসর ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে) প্রচেষ্টার ভূয়সী প্রশংসা করেন।
এ সময় কাতারের আমির প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের প্রশংসা করেন। তিনি আশ্বাস দেন যে, আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজনীয় সবধরনের সহায়তা অব্যাহত থাকবে। কাতারের আমির বলেন, কাতার এবং বাংলাদেশ স্বাক্ষরিত বিভিন্ন চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকসমূহ দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
সৌজন্য সাক্ষাৎকালে উভয় নেতা নিজেদের মধ্যে কুশল বিনিময় করেন এবং আনন্দ প্রকাশ করেন যে, এই সফর বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে বহুমুখী অংশীদারিত্বকে আরও জোরদার করার উপায় নির্ধারণ করবে।
বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, পররাষ্ট্র সচিব এবং বঙ্গভবনের সংশ্লিষ্ট সচিবগণ উপস্থিত ছিলেন। এদিকে কাতারের প্রতিনিধি দলে ছিলেন-আমিরি দেওয়ান প্রধান শেখ সৌদ বিন আবদুল রহমান আল-থানি, বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন হামাদ আল-থানি, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোলতান বিন সাদ আল-মুরাইখি এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত কাতারের রাষ্ট্রদূত সেরায়া বিন আলী আল-কাহতানি।
বৈঠক শেষে কাতারের আমির ফটো সেশনেও অংশ নেন। তিনি সেখানে রক্ষিত দর্শনার্থী বইতেও স্বাক্ষর করেন। বঙ্গভবনের ক্রেডেনশিয়াল হলে বৈঠক শেষে মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন কাতারের আমির ও তাঁর সফরসঙ্গীরা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, মন্ত্রী পরিষদের সদস্য, উপদেষ্টাবৃন্দ ও কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি এই ভোজে অংশ নেন। কাতারের আমিরের সম্মানে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
আমিরের নামে ঢাকায় সড়কের নামকরণ ॥ অনুষ্ঠানে কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির নামে রাজধানী ঢাকার একটি সড়ক ও একটি পার্কের নামকরণ করা হয়। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অধীনে মিরপুরের কালসি এলাকার বালুর মাঠে পার্কটি নির্মাণ করা হচ্ছে, মিরপুর ইসিবি চত্বর থেকে কালসি ফ্লাইওভার পর্যন্ত সড়কটির নামকরণ করা হয়েছে কাতারের আমিরের নামে। এখন থেকে রাস্তা ও পার্কটি শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি এভিনিউ এবং শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি পার্ক নামে পরিচিত হবে।
ঢাকা ছাড়লেন কুয়েতের আমির ॥ দুদিনের রাষ্ট্রীয় সফর শেষ করে মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকা ছেড়েছেন কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি। বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে বৈঠকের পর বিকেল সোয়া তিনটার দিকে তিনি নেপালের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন।
প্রসঙ্গত, ২০০৫ সালে কাতারের তৎকালীন আমির হামাদ বিন খলিফা আল থানি বাংলাদেশে এসেছিলেন। প্রায় ২০ বছর পর বর্তমান আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি বাংলাদেশ সফর করলেন।