নতুন সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছেন, দেশের যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত আছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী হিসেবে সামনের দিনগুলোতে সেনাবাহিনী কাজ করে যাবে। গতকাল রবিবার সেনাসদরে অনুষ্ঠিত দায়িত্ব হস্তান্তর ও গ্রহণের আনুষ্ঠানিকতা অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।
এর আগে সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে গতকাল সকালে গণভবনে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানকে জেনারেলের র্যাংক ব্যাজ পরানো হয়। নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল এম নাজমুল হাসান এবং বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল হাসান মাহমুদ খান সেনাপ্রধানকে জেনারেলের র্যাংক ব্যাজ পরিয়ে দেন। প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব কে এম শাখাওয়াত মুন বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
অনুষ্ঠান শেষে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী নতুন সেনাপ্রধানকে ফুলের তোড়া দিয়ে অভিনন্দন জানান এবং তার সাফল্য কামনা করেন। সেনাপ্রধানও প্রধানমন্ত্রীকে ফুলের তোড়া দিয়ে শুভেচ্ছা জানান এবং তার আশীর্বাদ কামনা করেন। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারেক আহমেদ সিদ্দিক, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জেল হোসেন মিয়া, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) লেফটেন্যান্ট জেনারেল মিজানুর রহমান শামীম, প্রতিরক্ষা সচিব মো. আশরাফ উদ্দিন, প্রেস সচিব মো. নাঈমুল ইসলাম খান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। নতুন সেনাপ্রধানকে তিন বছরের জন্য সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আগামী তিন বছরের জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দেবেন তিনি।
সেনাসদরে অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের নতুন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা ছাড়া কোনো ইস্যু নেই। তাই আমরা কারো উসকানিতে পা দেব না। জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, বাংলাদেশের যে কোনো দুর্যোগে সেনাবাহিনী জনগণের পাশে থাকে। বাংলাদেশের ওপর বহির্বিশ্বের যে কোনো আক্রমণ মোকাবিলার প্রস্তুতিও সেনাবাহিনীর ছিল, আছে এবং থাকবে।
সেনাসদরে নতুন সেনাপ্রধানকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন বিদায়ি সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ। তিন বছরের নেতৃত্ব শেষে বিদায় নেন জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ। পূর্ণ সামরিক রীতি অনুযায়ী তাকে ফুলেল সজ্জিত গাড়িতে রশি টেনে পার করে দেওয়া হয় সেনাসদর। এ সময় তাকে বিদায় জানাতে উপস্থিত ছিলেন সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সকালে শিখা অনির্বাণে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে শাহাদাতবরণকারী সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানান বিদায়ি সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ। পরে সেখানে থাকা পরিদর্শন বইয়ে স্বাক্ষর করেন তিনি। এরপর বিদায়ি সেনাপ্রধান যান সেনাকুঞ্জে। সেখানে সেনাবাহিনীর একটি চৌকশ দল তাকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করে। সেনাকুঞ্জে একটি গাছের চারা রোপণ করেন জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ। গত তিন বছর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দেন জেনারেল শফিউদ্দিন। তার স্থলাভিষিক্ত হলেন নতুন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।
বিদায়ের আগে যা বলে গেলেন সেনাপ্রধান এস এম শফিউদ্দিন : বিদায়ের আগে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চাকরি খুব চ্যালেঞ্জিং। সবসময় দেশের কল্যাণের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্য দেশের মঙ্গলের জন্য কাজ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে আধুনিকায়ন করেছেন বলেও বলেন তিনি। এর আগে সেনাবাহিনী প্রধান সাভার সেনানিবাসে পৌঁছে সেনাসদস্যদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভা করেন ও ডিওএইচএস এলাকায় ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি নির্মাণ শেষ হওয়া মসজিদ উদ্বোধন করেন ও বৃক্ষ রোপণ করেন।
জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ১৯৮৫ সালে ২০ ডিসেম্বর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য হিসেবে ১৩তম দীর্ঘমেয়াদি কোর্সের সঙ্গে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। সামরিক জীবনের শুরু থেকেই বিভিন্ন কোর্সে ভালো ফলাফলের ক্রমধারায় তিনি ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড ও স্টাফ কলেজ, মিরপুর থেকে সাফল্যের সঙ্গে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। পরবর্তী সময় তিনি জয়েন্ট সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজ, যুক্তরাজ্য থেকেও গ্র্যাজুয়েট হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় প্রথম শ্রেণিতে মাস্টার্স অব ডিফেন্স স্টাডিজ (এমডিএস) সম্পন্ন করেন এবং যুক্তরাজ্যস্থ কিংস কলেজ, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে মাস্টার্স অব আর্টস ইন ডিফেন্স স্টাডিজ ডিগ্রি অর্জন করেন। তার সুদীর্ঘ ৩৯ বছরের বর্ণাঢ্য সামরিক জীবন কমান্ড, স্টাফ ও প্রশিক্ষকের অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ। তিনি ২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে ৮ জুন ২০১০ পর্যন্ত ১৭ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক ও অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি তৎকালীন বিডিআর বিদ্রোহ দমনে নিষ্ঠা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেন। পরবর্তী সময় তিনি ২৭ জুলাই ২০১১ থেকে ১১ নভেম্বর ২০১৩ পর্যন্ত দুই বছরেরও বেশি সময় ৪৬ স্বতন্ত্র পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জিওসি হিসেবে ০২ এপ্রিল ২০১৪ থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ পর্যন্ত তিন বছর নবম পদাতিক ডিভিশন কমান্ড করেন। এরিয়া কমান্ডার, সাভার এরিয়া ও জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) নবম পদাতিক ডিভিশন হিসেবে তিনি টানা তিন বছর অত্যন্ত সফলভাবে বিজয় দিবস প্যারেড-২০১৪, ২০১৫ ও ২০১৬-এর প্যারেড কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। এই বিরল কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ‘সেনা গৌরব পদক’ (এসজিপি) এ ভূষিত হন। স্টাফ হিসেবে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত একটি ব্রিগেড, স্কুল অব ইনফ্যান্ট্রি অ্যান্ড ট্যাকটিকস (এসআইএন্ডটি) এবং সেনাসদরে বিভিন্ন পদবি ও নিয়োগে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি প্রশিক্ষক হিসেবে জেসিও এনসিও একাডেমি (জেএনএ), স্কুল অব ইনফ্যান্ট্রি এন্ড ট্যাকটিকস ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস সাপোর্ট এন্ড ট্রেনিং (বিপসট) এ অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে সব পদবির দেশি-বিদেশি সেনাসদস্যদের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন।
সেনাসদর সামরিক সচিবের শাখায় তিনি সহকারী সামরিক সচিব, উপ-সামরিক সচিব এবং সামরিক সচিব (এমএস) হিসেবে বিভিন্ন মেয়াদে দীর্ঘদিন কর্তব্যরত ছিলেন। সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে তিনি সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এর পূর্বে তিনি প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও-এএফডি) হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগে কর্মরত ছিলেন।
জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জাতিসংঘের ব্যানারে মিলিটারি অবজার্ভার হিসেবে এংগোলাতে এবং সিনিয়র অপারেশন অফিসার হিসেবে লাইবেরিয়াতে দায়িত্ব পালন করেন। সেনাবাহিনীতে তার কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি ‘অসামান্য সেবা পদক’ (ওএসপি)-এ ভূষিত হন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি হিসেবে দেশে ও বিদেশে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করেছেন এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এবং সারাহনাজ কমলিকা জামান দুই কন্যা সন্তানের (সামিহা রাইসা জামান এবং শাইরা ইবনাত জামান) গর্বিত জনক-জননী। তিনি একজন সজ্জন, ক্রীড়ামোদী ও প্রাণবন্ত অফিসার হিসেবে সর্বমহলে সুপরিচিত।