ছেলের ছাগলকাণ্ডে আলোচনায় আসা মতিউর রহমানের দুর্নীতির প্রাথমিক গন্ধ পেয়ে তার বিরুদ্ধে এখন ত্রিমুখী শাস্তিমূলক ব্যবস্থায় নেমেছে সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল রোববার তাকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। অন্যদিকে, মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করতে শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক)। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে তিন সদস্যের টিম গঠন করা হয়েছে। একই কাণ্ডে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জেরে গত বৃহস্পতিবারই অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ স্বউদ্যোগী হয়ে তাকে সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ পরিচালক পদ থেকেও সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আরও খবর হচ্ছে, খুব শিগগির মতিউরের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেবে এনবিআর। এমনকি তার সম্পদ জব্দ করার মতো পদক্ষেপও ভাসছে আলোচনায়।
এনবিআর সদস্য পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো: আলোচিত ছাগলকাণ্ডে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট ড. মতিউর রহমানকে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে (আইআরডি) সংযুক্ত করা হয়েছে। এর আগে ড. মতিউরের অঢেল সম্পদ নিয়ে কালবেলাসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে চলে আসে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আজ এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বিসিএস (শুল্ক ও আবগারি) ক্যাডারের কর্মকর্তা মতিউর রহমানকে তার বর্তমান পদ থেকে সরিয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করা হয়েছে। তবে কেন এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, প্রজ্ঞাপনে তা উল্লেখ করা হয়নি। বলা হয়েছে, ‘জনস্বার্থে জারিকৃত এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে।’
এনবিআর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অর্থমন্ত্রীর মৌখিক নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, কারও বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে হলে কিছু প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এটি প্রাথমিক ধাপ। পরে তদন্তে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান এই কর্মকর্তা। আর মতিউরের এসব অঢেল সম্পত্তি অর্জনের কাণ্ডে বিব্রত কাস্টমস কর্মকর্তারা। আজ সোমবার কাস্টমস ক্যাডারদের অ্যাসোসিয়েশনের পূর্বনির্ধারিত একটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। এই বৈঠকে বিষয়টি আলোচনায় উঠতে পারে বলেও জানিয়েছেন একাধিক কাস্টমস কর্মকর্তা।
সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত: একই কাণ্ডে মতিউর রহমানকে সোনালী ব্যাংকের বোর্ড থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের চেয়ারম্যান জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী। পর্ষদ সভা শেষে রোববার সাংবাদিকদের এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন তিনি।
জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী বলেন, পরিচালক সরকারি পোস্ট। অর্থ মন্ত্রণালয় চিঠি ইস্যু না হলে চূড়ান্ত অপসারণ হবে না। তবে মন্ত্রণালয় আমাদের জানিয়েছে তাকে (মতিউর) সরানো হবে। আমাদের সোনালী ব্যাংকের বোর্ড থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। চূড়ান্ত অপসারণ চিঠি ইস্যুর পর। তবে এখন থেকে মতিউর রহমান সোনালী ব্যাংকের কোনো সভায় থাকতে পারবেন না।
সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও সিইও মো. আফজাল করিম বলেন, আজকে বোর্ড মিটিং হয়েছে। ড. মতিউর রহমানকে আসতে মৌখিকভাবে নিষেধ করা হয়েছে। তবে ব্যাংকের পরিচালকের পদ থেকে সরানো হয়েছে কি না এটা জানা নেই। যদি এ ধরনের আদেশ জারি হয়, তাহলে বলতে পারব।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্র জানায়, মতিউরকে সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ থেকে সরিয়ে দিতে গত বৃহস্পতিবারই আইনি প্রক্রিয়া খোঁজা হয়। তারই ভিত্তিতে এ-সংক্রান্ত একটি সারসংক্ষেপ অর্থমন্ত্রীর জন্য তৈরি করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী এবং অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান উভয়ই এখন ভিয়েনায় রয়েছেন। তারা দেশে এলে কিংবা এরই মধ্যে ভিয়েনা থেকে কোনো বার্তা এলে তাকে পরিচালক পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।
দুর্নীতি তদন্তে দুদকের তিন সদস্যের টিম গঠন দুদকের: এনবিআর কর্মকর্তা ড. মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্যের টিম গঠন করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। রোববার দুদকের প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির সচিব খোরশেদা ইয়াসিন এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, এনবিআর কর্মকর্তা ড. মো. মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের অভিযোগে গত ৪ জুন ২০২৪ তারিখে কমিশন একটি অনুসন্ধান টিমের মাধ্যমে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ইতোমধ্যে একজন উপপরিচালককে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়েছে। টিমের সদস্যরা তাদের কাজও শুরু করেছেন।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের উপপরিচালক মো. আনোয়ার হোসেনকে। এ ছাড়া কমিটির বাকি দুই সদস্য হলেন সহকারী পরিচালক (যাবাক) মাহমুদুল হাসান ও উপসহকারী পরিচালক (যাবাক) সাবিকুন নাহার।
এর আগেও মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে চারবার দুদকে অভিযোগ এসেছে এবং প্রতিবারই তাকে ক্লিন সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে। তাহলে কি আগের কর্মকর্তারা তদন্তকাজ ঠিকমতো করেননি—এমন প্রশ্নে দুদক সচিব বলেন, ‘আগে তার বিরুদ্ধে কী কী অভিযোগ উঠেছে, কারা তদন্ত করেছে, তখন অভিযোগের মাত্রা কেমন ছিল—সব বিষয়ই খতিয়ে দেখা হবে। সেইসঙ্গে মতিউরের দুর্নীতির সঙ্গে কারও পৃষ্ঠপোষকতা বা যোগসাজশ আছে কি না—সব বিষয়েই খতিয়ে দেখা হবে।