আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বাঙালির প্রতিটি অর্জনই এসেছে আওয়ামী লীগের হাত ধরে। জন্ম থেকে আওয়ামী লীগের প্রতিটি পদক্ষেপের কারণেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সব সময় মানুষের সুখে-দুঃখে মানুষের পাশে ছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু বারবার এই দলকে আঘাত করা হয়েছে, নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা হয়েছে। যতবার আঘাত এসেছে ততবারই ভষ্ম থেকে জেগে ওঠা ফিনিক্স পাখির মতো আওয়ামী লীগও জেগে উঠেছে। বঙ্গবন্ধুর সৈনিকরা কখনো পরাভব মানে না, মাথানত করে না। আগামীতেও করবে না।’
গতকাল রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী প্লাটিনাম-জয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। হাজার হাজার নেতাকর্মীর উপস্থিতিতে আলোচনা সভাটি বিশাল জনসভায় রূপ নেয়। বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুসহ ১৪ দলের নেতৃবৃন্দ, আমন্ত্রিত অতিথি এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক ও দাতা সংস্থার প্রতিনিধিরাও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জনগণের শক্তি অপরিসীম। আওয়ামী লীগ জনগণের শক্তিতে বিশ্বাস করে। সংগঠন শক্তিশালী হলে আর জনসমর্থন থাকলে যতই ষড়যন্ত্র হোক, কেউ কিছু করতে পারবে না। আর যে কোনো সময় মৃত্যু আসতে পারে, কিন্তু আমি মৃত্যুকে ভয় করি না। যতক্ষণ শ্বাস আছে ততক্ষণ দেশের জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনে কাজ করে যাব। বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে আমার বাবার যে চিন্তা-চেতনা, তা বাস্তবায়ন করে এ দেশের মানুষকে একটা উন্নত জীবন দেব। এটাই আমাদের লক্ষ্য।’
দলীয় সদস্যদের উদ্দেশ্যে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার একটাই আবেদন থাকবে আমাদের সংগঠনের প্রত্যেক নেতাকর্মীর কাছে, সংগঠনকে সুসংগঠিত করতে হবে। যদি সংগঠন শক্তিশালী হয় আর গণমানুষের সমর্থন পাওয়া যায়, তবে যতই ষড়যন্ত্র হোক, সফল হওয়া যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বলব- আপনারা একবার চিন্তা করে দেখুন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কত কষ্ট করেছেন। বারবার আঘাত এসেছে। পরিবারগুলো কষ্ট করেছে। কিন্তু সংগঠন ধরে রেখেছে। কাজেই যেমন সংগঠন করতে হবে, সেভাবে জনগণের আস্থা-বিশ্বাস অর্জন করতে হবে, যেটা আমাদের মূল শক্তি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘জনগণের সেই আস্থা-বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছি বলেই বারবার জনগণ আমাদের ভোট দিয়েছে। আওয়ামী লীগ বারবার ক্ষমতায় আসায়, দীর্ঘসময় বাংলাদেশের
ইতিহাসে ২০০৯ থেকে এই ২০২৪ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে। আর গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে বলেই আজকে আর্থ-সামাজিকভাবে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশের উন্নতি হচ্ছে। বাংলাদেশ আজকে বিশ্ব দরবারে রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বিশ্বে আজকে মাথা উঁচু করে চলার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কাজেই এটাকে ধরে রেখেই আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘২১০০ সাল পর্যন্ত আমরা ডেল্টা প্ল্যান রূপকল্প ঘোষণা করেছি। অনেক বয়স হয়েছে, ততদিন হয়তো বেঁচে থাকব না। কিন্তু আজকে যারা নবীন, যারা আমার স্মার্ট বাংলাদেশের মূল সৈনিক হবে। আমরা স্মার্ট জনগোষ্ঠী গড়ে তুলব; স্মার্ট সরকার, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সোসাইটি গড়ে তুলে এই বাংলাদেশ বিশ্বে মাথা উঁচু করে এগিয়ে যাবে- প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর প্লাটিনাম-জয়ন্তীতে এটাই আমাদের প্রতিজ্ঞা।’
যারা দলের চেয়ে নিজেকে বড় মনে করেছেন এবং দল ছেড়ে চলে গেছেন, তারা ভুল করেছেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগে থাকা অবস্থায় তারকা থাকলেও পরে সে তারা আর জ্বলেনি, নিভে গেছে। দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা ভাসানী ও সাধারণ সম্পাদক শামসুল হককে স্মরণ করে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ছাড়া যারা ক্ষমতায় এসেছে তারা সন্ত্রাসবাদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অস্ত্রের ঝনঝনানি, দুর্নীতি করেছে। তারা জনগণের শক্তি ভুলে গিয়েছিল। আওয়ামী লীগ জনগণের শক্তিতে বিশ্বাস করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর বারবার ক্ষমতা বদল হয়েছে। হয় অস্ত্রের মাধ্যমে, না হয় ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে শাসকরা ক্ষমতায় এসেছে। সেই সময় জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ছিল না। জনগণের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারেনি তারা। একমাত্র আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেই দেশের জনগণ বুঝতে পারে সরকার মানে জনগণের সেবক। আমরা জনগণের সেবক হয়েই তাদের ভাগ্য পরিবর্তনে কাজ করে যাচ্ছি।’
বক্তব্যের একপর্যায়ে আবেগাপ্লুত হয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে, কিন্তু তার আদর্শকে হত্যা করতে পারেনি। আর আমি বড় সন্তান হিসেবে পাশে থেকে জেনেছি তার স্বপ্ন। কীভাবে তিনি বাংলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চান। সব ফেলে ফিরে এসেছিলাম এমন এক দেশে, যেখানে যুদ্ধপরাধীদের বিচার শুরু করেছিলেন আমার বাবা, তা বন্ধ করে দিয়ে তাদের মুক্ত করে দিয়ে রাজনীতি করার সুযোগ দেয় জিয়াউর রহমান। ১৫ আগস্টের আত্মস্বীকৃত খুনিদের ইনডেমনিটি দিয়ে, বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। এ অবস্থার মধ্যে শুধু দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে আমি দেশে ফিরে এসেছিলাম।’
প্রধানমন্ত্রী স্বভাবজাতভাবে বক্তব্যের শেষাংশে সুকান্ত ভট্টচার্যের কবিতা উচ্চারণ করে বলেন, ‘যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ, প্রাণপণে দু’হাতে সরাব জঞ্জাল। এ বিশ্বকে বাসযোগ্য করে যাব আমি, নতুন প্রজন্মের কাছে এ আমার অঙ্গীকার।’
বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে প্রধানমন্ত্রী সভামঞ্চে আসেন। জাতীয় সংগীতের সঙ্গে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এবং দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এরপর বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার প্লাটিনাম-জয়ন্তীর কর্মসূচির উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।
এরপর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করা হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীবৃন্দ এবং দেশের প্রখ্যাত শিল্পীরা সংগীত পরিবেশন করেন। আওয়ামী লীগের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে নৃত্যানুষ্ঠানও পরিবেশন করা হয়। সাংস্কৃতিক পর্ব পরিচালনা করেন আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিকবিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল। সাংস্কৃতিক পর্বের শুরুতে পরিবেশন করা হয় আওয়ামী লীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর থিম সং। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে দলটির নেতৃত্বে মহান স্বাধীনতা অর্জন, পঁচাত্তরপরবর্তী প্রেক্ষাপট, ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনার ফিরে আসা, দলকে সুসংগঠিত করা, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে দেশের উন্নয়ন-অর্জন তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তুলে নাচ ও গান পরিবেশন করা হয়।
এরপর বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ পাঠ শেষে আলোচনা সভা শুরু হয়। এতে বক্তব্য রাখেন ওবায়দুল কাদের। আলোচনা সভা সঞ্চালনা করেন কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ। মঞ্চে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।