প্রথম ধাপে ১৫০ উপজেলায় নির্বাচন * দুই চেয়ারম্যানসহ ১২ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের পথে
প্রথম ধাপের ১৫০টি উপজেলা নির্বাচনের বেশ কয়েকটিতে চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন বিএনপি ও জামায়াত নেতা। তারা অনলাইনে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন বর্জন করে আসছে বিএনপি ও জামায়াত। কিন্তু এবার নির্বাচন বর্জনে কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করেই ওইসব উপজেলায় দল দুটির নেতারা প্রার্থী হয়েছেন। তবে কত উপজেলায় মোট কতজন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন তার প্রকৃত তথ্য পাওয়া যায়নি। যুগান্তরের ব্যুরো, জেলা ও উপজেলা অফিস থেকে পাঠানো প্রতিবেদনে এ সংখ্যা ৫০ জনের কম নয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গতকাল সোমবার বিকাল ৪টায় প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমার সময় শেষ হয়েছে। আগামী ৮ মে প্রথম ধাপের ১৫০ উপজেলায় ভোটগ্রহণ হবে।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ১৫০টি উপজেলায় মোট ১৮৯০ প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ৬৯৫ জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৭২৪ জন ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৪৭১ জন রয়েছেন। মনোনয়নপত্র দাখিলের দিনই বাগেরহাট সদর ও মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলা চেয়ারম্যানসহ ১২টি পদে একজন করে প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। তারা সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হতে চলেছেন। বাকি শুধু আনুষ্ঠানিকতা।
বাগেরহাট সদর উপজেলায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান পদে জয়ী হতে যাচ্ছেন বর্তমান চেয়ারম্যান ও জেলা যুবলীগ সভাপতি সরদার নাসির উদ্দিন। এ উপজেলায় মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে রিজিয়া পারভীনও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। এর আগের নির্বাচনেও তারা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছিলেন। তবে এ উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান পদে চারজন প্রার্থী হয়েছেন। আরেকজন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলায়। এ উপজেলার বর্তমান চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আনিছুজ্জামান আনিস একক প্রার্থী হিসাবে আবারও নির্বাচিত হওয়ার পথে রয়েছেন। মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে দুজন করে প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন।
মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক রাহেনা বেগম হাছনা। এ নিয়ে টানা চতুর্থবার জয় পেতে যাচ্ছেন তিনি। এছাড়া কক্সবাজার সদর ও চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান পদে একজন করে প্রার্থী রয়েছেন। নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পেতে যাচ্ছেন প্রার্থীরা। কুষ্টিয়া সদর, চাঁদপুরের মতলব উত্তর, চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা ও ঠাকুরগাঁওর বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে একক প্রার্থী রয়েছেন।প্রথম ধাপে ১৫০ উপজেলায় ১৮৯০ জনের মনোনয়নপত্র দাখিলের তথ্য যুগান্তরকে নিশ্চিত করেছেন নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, অনলাইনে মনোনয়নপত্র দাখিল হওয়ায় কোথাও উল্লেখ করার মতো আচরণবিধি লংঘনের খবর পাওয়া যায়নি। প্রার্থীরা সহজেই অনলাইনে আবেদন করতে পেরেছেন।
নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, এবারই প্রথম পুরোপুরি অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। এ কারণে মনোনয়নপত্র দাখিলের দিন রিটার্নিং কর্মকর্তার দপ্তরগুলোতে শোরগোল ছিল না, আচরণ বিধিমালা লংঘনেরও খবর পাওয়া যায়নি। গত নির্বাচনে অনলাইন ও অফলাইন দুভাবেই জমা দেওয়ার সুযোগ ছিল। তখন অনলাইনে তেমন সাড়া মেলেনি।
তারা আরও জানান, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ীর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। কারণ জমা হওয়া মনোনয়নপত্র আগামীকাল বুধবার যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তারা। বাছাইয়ে বৈধ বা বাতিল হওয়া মনোনয়নপত্রের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে ১৮-২০ এপ্রিল। ওইসব আপিলের ওপর শুনানি হবে ২১ এপ্রিল। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন ২২ এপ্রিল। নির্বাচনি এই প্রক্রিয়ায় প্রার্থীর সংখ্যা আরও কমবে। তখন একক প্রার্থীর সংখ্যা বাড়তে পারে। তারা আরও জানান, ১৬টি উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে দুজন করে প্রার্থী হয়েছেন। এসব উপজেলায় একজন প্রত্যাহার করলেই অপরজন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হবেন।
নির্বাচন কমিশন গত ২১ মার্চ ১৫২টি উপজেলা নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করে। তফশিল ঘোষণার পর কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলা দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে সরিয়ে নেওয়া হয়। আর নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাচন আইনি জটিলতায় স্থগিত করা হয়েছে। বাকি ১৫০টিতে ভোট হতে যাচ্ছে। এর মধ্যে ২২টিতে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) এবং বাকি উপজেলাগুলোতে কাগজের ব্যালটে ভোটগ্রহণ হবে।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বিধিমালায় দলীয় প্রতীক থাকলেও এবার প্রার্থী মনোনয়ন দেবে না বলে আগেই ঘোষণা দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচন দলীয় নেতাকর্মীদের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়। অপরদিকে নির্বাচন কমিশনও স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার বিধান শিথিল করে। স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে ২৫০ জন ভোটারের সমর্থনসূচক স্বাক্ষর জমা দেওয়ার বিধান বাতিল করা হয়। তবে জামানতের বিধানে কড়াকড়ি করা হয়েছে। স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ তৈরি হওয়ায় অনেক উপজেলায় বিপুলসংখ্যক প্রার্থী হয়েছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল ও সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলা চেয়ারম্যান পদে ১১ জন করে প্রার্থী হয়েছেন। নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলায় ১০ জন চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন।
যেসব উপজেলায় প্রার্থী হয়েছেন বিএনপি ও জামায়াত নেতারা : আমাদের ব্যুরো, জেলা ও উপজেলা অফিস থেকে পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে ৫ জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৩ জন ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ২ জন মনোনয়ন পত্র দাখিল করেছেন। এ উপজেলায় সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আতাউর রহমান মুকুল চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। বাকি প্রার্থীরা হলেন-বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা এমএ রশিদ, মুছাপুর ইউপি চেয়ারম্যান ও জেলা জাতীয় পার্টির সহসভাপতি মাকসুদ হোসেন, তার ছেলে মাহমুদুল হাসান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক একেএম আবু সুফিয়ান।
প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে বিএনপি নেতা আতাউর রহমান মুকুল বলেন, এবার দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হবে না। তাই আমি মনোনয়নপত্র দাখিল করেছি। আল্লাহতায়ালা যাকে নির্ধারণ করে রেখেছেন তিনিই নির্বাচিত হবেন। আমি জনগণের খেদমত করে যাচ্ছি। এটাই আমার মূল লক্ষ্য।
নাটোরের ধামইরহাট উপজেলায় বিএনপি নেতা মো. আয়েন উদ্দিন ডালিম; মহাদেবপুরে উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন; ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নুরুজ্জামান লস্কর তপু; কুমিল্লার মেঘনায় উপজেলা বিএনপি সভাপতি মো. রমিজ উদ্দিন; একই উপজেলার নাঙ্গলকোটে উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি মো. মাজহারুল ইসলাম; চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলায় বিএনপি নেতা মো. আশরাফ হোসেন আলিম ও তার ছেলে আব্দুল্লাহ আল রাইহান; ভোলাহাট উপজেলায় বিএনপির মোহাম্মদ বাবর আলী, মো. আনোয়ারুল ইসলাম ও ইয়াজদানী আলীম আল রাজী; ময়মনসিংহের ফুলপুরে পৌর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এমরান হাসান পল্লব চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছেন।
একইভাবে নাটোর সদর উপজেলায় বিএনপি নেতা গোলাম সরোয়ার ও বিএনপি কর্মী সাবেক ভিপি মো. ইসতেয়াক আহম্মেদ (হিরা); একই জেলার নলডাঙ্গা উপজেলায় বিএনপির উপজেলা কমিটির সহ-সভাপতি সরদার আফজাল হোসেন; পিরোজপুরের ইন্দুরকানীতে উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক ভাইস-চেয়ারম্যান ফায়জুল কবির তালুকদার; বান্দরবন সদর উপজেলায় জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মো. আব্দুল কুদ্দুছ; নওগাঁর মহাদেবপুরে থানা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মো. সাজ্জাদ হোসেন; সিলেটের বিশ্বনাথে উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক ও সাবেক ভাস চেয়ারম্যান গৌছ খান, যুক্তরাজ্য বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সেবুল মিয়া ও যুক্তরাজ্য বিএনপি নেতা সফিক উদ্দিন চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছেন।
একইভাবে আরও অনেক উপজেলায় চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে দলটির অনেক নেতা প্রার্থী হয়েছেন।
জামায়াত : চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে জামায়াতে ইসলামীর উপজেলা আমির আব্দুর রশিদ পাটোয়ারী, নাটোরের ধামইরহাট উপজেলায় নায়েবে আমির মাওলানা মো. আতাউর রহমান, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলা আমির ওলিউর রহমান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলে সাবেক জামায়াত নেতা মো. সিরাজুল ইসলাম, কুষ্টিয়া সদর উপজেলায় জেলা জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক সুজা উদ্দিন জোয়ার্দার, দিনাজপুরের বিরামপুরে জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির এনামুল হক, লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলায় জামায়াত নেতা হাবিবুর রহমান এবং সিলেটের বিশ্বনাথে উপজেলা আমির নিজাম উদ্দিন সিদ্দিকী চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছেন। এর বাইরে বেশ কয়েকটি উপজেলা নির্বাচনে জামায়াত নেতারা প্রার্থী হয়েছেন।