নতুন শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থার খোলনলচে পরিবর্তনের আশ^াস দিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ধাপে ধাপে চলছে সে কার্যক্রম। এ নিয়ে অভিভাবকদের একাংশের অভিযোগও রয়েছে বিস্তর। তবে মূল্যায়ন কাঠামোর যে চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে সেখানে খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। সাত পর্যায়ের মূল্যায়ন পদ্ধতি আগের মতোই থাকছে। নামও থাকছে একই। শুধু অভিভাবক ও সাধারণের বোঝার সুবিধার্থে মূল্যায়নের পাশে লেটার (বর্ণ) চালু করা হচ্ছে।
সোমবার জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটির (এনসিসিসি) সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সভায় অংশ নেওয়া একাধিক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, নতুন শিক্ষাক্রমে যে মূল্যায়ন পদ্ধতি এনসিসিসির সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, তাতে মূল্যায়ন হবে সাতটি পর্যায়ে। সেগুলো হচ্ছে অনন্য, অর্জনমুখী, অগ্রগামী, সক্রিয়, অনুসন্ধানী, বিকাশমান ও প্রারম্ভিক। সবচেয়ে যে ভালো করবে সে ‘অনন্য’ পাবে। শিখনকালীন অর্থাৎ শ্রেণি কার্যক্রমের ওপর ৩৫ শতাংশ মূল্যায়ন করা হবে। বছর শেষে হবে সামষ্টিক মূল্যায়ন।
সেখানে পরীক্ষা নেওয়া হবে, যার ওয়েটেজ হবে ৬৫ শতাংশ। শ্রেণি কার্যক্রম বলতে অ্যাসাইনমেন্ট, উপস্থাপনা, অনুসন্ধান, প্রদর্শন, সমস্যা সমাধান ও পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ করবে শিক্ষার্থীরা। আর বছর শেষে পাঁচ ঘণ্টার (বিরতিসহ) মূল্যায়নে অংশ নেবে শিক্ষার্থীরা। সেখানে তারা ব্যক্তিগত, দলভিত্তিক বিভিন্ন কাজে অংশ নেবে। লিখিত অংশের প্রশ্নপত্র হবে শ্রেণি কার্যক্রমের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল রেখে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটির সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক এম তারিক আহসান জনকণ্ঠকে বলেন, বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় জিপিএ (গ্রেড পয়েন্ট এভারেজ) চালু রয়েছে। এতে এ+, এ, বি এমনভাবে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হচ্ছে। কেউ যদি ৮০ বা এর বেশি পায় তাকে এ+ দেওয়া হয়। ২০২৬ সালের এসএসসি পরীক্ষায় আর এই নিয়ম থাকছে না। সাতটি স্কেলে মূল্যায়ন হবে। তবে মূল্যায়ন ফলের নামের পাশে একটি বর্ণ থাকবে। যাকে আমরা লেটার গ্রেডিং বলতে পারি। এ ছাড়া শিখন কার্যক্রমে যে বিষয়গুলো ছিল তা একই থাকবে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্র জানায়, নতুন শিক্ষাক্রমে ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে প্রথমবার এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এ পরীক্ষা বর্তমানে প্রচলিত নিয়মে হবে না। এনসিসিসিতে অনুমোদিত নতুন পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করা হবে। তবে সভায় ফল প্রকাশের ক্ষেত্রে গ্রেডিংটা রাখা যায় কি না, তা নিয়ে বৈঠকে আলোচনা ওঠে। তখন শিক্ষামন্ত্রী সার্বিক দিক বিবেচনা করে অন্তত প্রথমবার গ্রেডিং পদ্ধতি রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
তবে জাতীয় শিক্ষাক্রম প্রণয়নকারী বোর্ড (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. মশিউজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, মূল্যায়ন পদ্ধতিকে লেটার গ্রেড হিসেবে চিহ্নিত করা হবে না। বরং যে শিক্ষার্থী ভালো করবে সে ‘অনন্য’ যোগ্যতা অর্জন করবে। আমরা বোঝানোর স্বার্থে অনন্যর পাশে এ গ্রেড রাখতে চাইছি। এরমানে এই নয় যে সে ৮০ + নম্বর পেয়েছে। ওই শিক্ষার্থী মূল্যায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে কেমন করেছে সেটিই ফলে উঠে আসবে। তিনি আরও জানান, সবে তো এনসিসিসি সভায় এ বিষয়টি অনুমোদন হয়েছে। আমারা এখনো কাজ শুরু করিনি। খুব শীঘ্রই এ বিষয়ে কার্যক্রম শুরু হবে বলেও তিনি নিশ্চিত করেন।
বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ শাহ আলমগীর জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটির (এনসিসিসি) স্থায়ী সদস্য। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ বৈঠকে একটা আলাপ হয়েছে। সেটা হলো- শিক্ষার্থীরা যে ফলাফল পাবে, সেটাতে ইনডিকেটর বা চিহ্নভিত্তিক ফল যাই বলি না কেন, সেটা দিলে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেমন প্রতিক্রিয়া হবে, তা নিয়ে কিছুটা সংশয় বা অস্পষ্টতা রয়েছে।
কাজেই শিক্ষামন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন যে, চিহ্নভিত্তিক না করে আমরা আগের মতো গ্রেডিং রাখতে পারি। এটা এসএসসি, দাখিল কিংবা ভোকেশনাল সব ক্ষেত্রে।
তারিক আহসান বলেন, এখনো কারিগরি ও মাদ্রাসার বিশেষায়িত বিষয় নতুন কারিকুলামের অন্তর্ভুক্ত হয়নি। সে কারণে ২০২৬ সালের এসএসসি পরীক্ষায় শুধু ওই বিষয়গুলো আগের মতোই মূল্যায়ন হবে। কিন্তু বাকি যে বিষয় রয়েছে সেটি নতুন শিক্ষাক্রমের মূল্যায়ন পদ্ধতিতে করা হবে।
মাদ্রাসা বোর্ড সংশ্লিষ্টরা জানান, মাদ্রাসা বোর্ডের অধীনে দাখিল এবং কারিগরি বোর্ডের অধীনে এসএসসি পরীক্ষায় মূল্যায়ন হবে দুই পদ্ধতিতে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মাদ্রাসার যে ৯টি বিষয়ের মিল রয়েছে, সেগুলোতে মূল্যায়ন করা হবে নতুন শিক্ষাক্রমে। তবে বিশেষায়িত পাঁচটি বিষয়ের পরীক্ষা নেওয়া হবে আগের নিয়মে। একইভাবে কারিগরির এসএসসি পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হবে। অর্থাৎ, দুই ধরনের পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে মাদ্রাসা ও কারিগরির শিক্ষার্থীদের। আগামী দুই বছর এ প্রক্রিয়া চলবে।
তার পর অর্থাৎ, ২০২৮ সাল থেকে সব বিষয়ে নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়ন করা হবে।
‘জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১’ অনুযায়ী ২০২৩ সালে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করেছে সরকার। চলতি বছর দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে, ২০২৬ সালে একাদশ এবং ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে এ প্রক্রিয়া চালু হবে।
২০২২ সাল থেকে নতুন এ শিক্ষাক্রমের মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে এনসিটিবি।