১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সেদিন পাক সেনাদের কাছে কখনও মাথা নত করেনি। আজও বিদেশী সকল ষড়যন্ত্রের রক্ষচক্ষুকে ভয় পাইনা। মুক্তিযোদ্ধার চেতনায় দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। স্বাধীনতা যুদ্ধে রনাঙ্গনের সেই স্মৃতি আজও কাঁদিয়ে বেড়ায়। সহযোদ্ধার লাশ কাঁধে বহন করে নিয়ে জীবন বাজি রেখে তবুও যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়েছে। কথাগুলো বললেন, ১৯৭১ সালে রাজাকার পাক সেনাদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেয়া রনাঙ্গনের সেদিনের একজন ফাইটার যুদ্ধাহত বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের ধানসাগর গ্রামের এক বীর মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধকালীন কমান্ডার সুবেদার (অব.) আব্দুল গফফার (৯২)। যার মুক্তিবার্তা নং-০৪০৩০৬০, বাংলাদেশ গেজেট নং-৩১৩৮।
রাজাকারদের ক্যাম্প আক্রমনের পূর্বে রাজাকারদের উদ্দেশ্যে লেখা এ বীর মুক্তিযোদ্ধার একখানা চিঠি। চিঠিখানা ছিলো এরকম রাজাকার ভাইয়েরা আমার কাছে তোমরা যদি আত্মসমর্পণ করো তাহলে তোমাদেরকে সাদরে গ্রহণ করবো। আর যদি যুদ্ধের মাধ্যমে ধরিতে পারি তাহলে কুত্তার মতো জবাই করিবো। তোমাদের যদি শক্তি সামর্থ থাকে আমাকে আক্রমন করতে পারো। ইতি সুবেদার আব্দুল গফফার। যা স্বাধীনতার পরে মুক্তিযোদ্ধার ইতিহাস বইয়ে ১৫খন্ডের ১০ম খন্ডের ৯নং সেক্টরের ৪৩৭ পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ রয়েছে। যুদ্ধকালীণ সময়ে সুন্দরবন সাব সেক্টরের কমান্ডার মেজর জিয়াউদ্দিন স.ম কবির আহম্মেদ মধুর নিজ হাতে লেখা চিঠিগুলোর স্মৃতি আজো তার কাছে রয়েছে।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, এ বীর মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার (অব.) আব্দুল গফফার যুদ্ধকালিন সময়ে ৯ নং সেক্টর সুন্দরবন সাব-সেক্টর মেজর জিয়া উদ্দিনের অধিনে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে সেদিন দেশমাতৃকার টানে যুদ্ধে যাপিয়ে পড়েছিলেন। বয়স তখন তার ২৮ বছর। ১৯৬২ সালে বাগেরহাট পিসি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে নৌ-বাহিনী চাকুরিতে যোগদান করেন। তার কর্মস্থল ছিলো পাকিস্তানের রাজধানীর করাচিতে সেখান থেকে ১৯৭১ সালের ২১ শে ফেব্রæয়ারি তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তান বর্তমান বাংলাদেশে ছুটিতে আসেন। এর পূর্বেও এ যোদ্ধা ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধেও একজন যোদ্ধা ছিলেন।
৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষন শুনে স্থির করলেন যুদ্ধ যখন শিখেছি বাঙ্গালির মুক্তির জন্য আরেকটি যুদ্ধ করতে হবে। কারন পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ঘৃনার চোখে দেখতেন। বাঙালিদের চাকুরির ক্ষেত্রে প্রমোশন দিতেন না। এর পরে তিনি সুন্দরবন সাব সেক্টরের অধিনেই পার্শ্ববতী শরণখোলায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে মাত্র ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে শরণখোলা থানা আক্রমনের পরিকল্পনা নেয়। ৭১ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে তখন রাজাকার সৃষ্টি হয়নি। কোন একদিন রাত ১টার দিকে থানা আক্রমন করেন তিনি। থানা পুলিশের নিকট থেকে ১২ টি রাইফেল নিয়ে যান তাদের ক্যাম্প সুন্দরবনের তাম্বুল বাড়ি ঘাটিতে। এর কিছুদিন পূর্বে সাগরে শেষ সিমান্ত বগি ফরেস্ট অফিস এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ছিলো। সেখান থেকে ৪ কিলোমিটার দূরত্বে শরণখোলা উপজেলার রায়েন্দা বাজারে ২২ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে এ বীর মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার (অব.) আব্দুল গফফার গভীর রাতে অবস্থান নেন। দ্বিতীয়বার রাজাকার ক্যাম্প আক্রমনের পরিকল্পনা। দিনটি ছিল ১১ জুলাই রাত তখন ৪টা বাজে। পাক সেনাদের সাথে ৫ ঘন্টা তুমুল যুদ্ধ। রাজাকার ক্যাম্পে ৩২০ জন অবস্থান করছিলো। পরের দিন সকাল ৯টার দিকে রাজাকারদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে সুবেদার (অব.) আব্দুল গফফার রাজাকারদের গুলিতে বুলেট বৃদ্ধ হন। পেটের বামপাশ থেকে একটি গুলি ঢুকে তার ডানপাশ থেকে বেরিয়ে যায়। সাথে থাকা মুক্তিযোদ্ধা মোদাচ্ছের হোসেনের পরিহিত লুঙ্গি ছিড়ে ক্ষত স্থানে বান দিয়ে তবুও থেমে থাকেনি তিনি। রাজাকারদের সাথে প্রাণ পনে যুদ্ধ করে গুলি চালিয়ে ১১ জন রাজাকারকে হত্যা করেন। এ যুদ্ধে এ সময় তার সাথে থাকা বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন গুলি খেয়ে শহীদ হন। আরো একজন যোদ্ধা হাবীব ডাক্তার তার গলায় ও বুকে গুলিবিদ্ধ হন। পরে তিনি যুদ্ধ বন্ধ করে সহযোদ্ধার লাশ কাধে নিয়ে ও আহত মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে ক্যাম্পে ফিরে যান। তিনি নিজেও গুলীবিদ্ধ জখমী থাকায় পরবর্তীতে ভারতের টাকি হাসপাতালে ১মাস চিকিৎসা শেষে দেশে পুনরায় ভারত থেকে ফিরে আসার সময় সুন্দরবন সাব সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াউদ্দিনের সাথে ডিঙি বোঝাই করে রাইফেল, এস এল আর, এল এম জি (লাইট মেশিনগান), এস এম জি ( শর্ট মেশিনগান), একটি রকেট লাঞ্চার এবং ৩ইঞ্চি মর্টার নিয়ে সুন্দবনের মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাটিতে ফেরত আসেন। সর্বশেষ তার পাক সেনাদের সাথে বড় একটা যুদ্ধ হয় এ বীর মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার আব্দুল গফফারের সাথে। বরিশাল জেলার মঠবাড়ীয়া থানার রাজাকার ক্যাম্প আক্রমনে সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে। বেতমোর আমড়াগাছিয়া গ্রামে অবস্থান নেয় মুক্তিযোদ্ধারা। ওখান থেকে দেড় কিলোমিটার দুরে মঠবাড়ীয়া বাজারে রাজাকাদের বড় ক্যাম্প ছিলো। ওরা সংখ্যায় ছিলো সংখ্যায় ৩২০জন। হেমায়েত সুফী ছিলেন রাজাকার কমান্ডার। তারই চাচাতো ভাইয়ের কাছে রাজাকারদের আত্মসমপর্ণের চিঠি পাঠানো হয়। চিঠি পেয়ে রাজাকাররা আরো সংগঠিত হয়। ঢাকা, খুলনা ও বরিশাল থেকে সংবাদ পাঠিয়ে আরো ২শতাধিক পাক সেনা হাজির করে। এ সংবাদ পেয়ে প্রস্তুতি নিলাম আক্রমনের। সংখ্যায় ১৮জন মুক্তিযোদ্ধা। পরেরদিন সকালে রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের কাছাকাছি আমরাগাছিয়া বাজারে আগুন ধরিয়ে দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের ৩টি অংশে ভাগ করা হলো। প্রতি গ্রæপে ৬জন করে। পাক সেনারা যেদিক থেকে আক্রমন শুরু করলো সেদিকেই সামনের দিকে এ যোদ্ধা সুবেদার আব্দুল গফফার ৬জনকে নিয়ে অগ্রসর হতে লাগলো। পাক সেনারা কাছাকাছি আসামাত্রই ৩দিক থেকে গুলি ছোড়া শুরু করলো মুক্তিযোদ্ধারা। প্রথমে ওরা ভেবেছিলো মুক্তিযোদ্ধারা পালিয়ে গেছে। তার হাতে থাকা ব্রাশ ফায়ারের ২৪জন পাকসেনা গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে মারা যায়। সকাল ৬টা থেকে ১২টা পর্যন্ত ৭ঘন্টা তুমুল যুদ্ধে আরো ৮৫জন রাজাকার ১২জন পাক সেনা মারা যায়। পরে দুপুর ১টার দিকে পাক সেনারা মঠবাড়ীয়া দৌড়ে পালিয়ে যায়। এসময় ওই যুদ্ধে ১১০জন রাজাকার ও পাক সেনা হত্যা হয়। পরেরদিন চারিদিকে খবর ছড়িয়ে পড়ে পাক সেনাদের হাতে সুবেদার গফফার ধরা পড়েছে। কিন্তু না পরেরদিন ১২টি পাকসেনাদের জবাইকৃত মাথা ঝাকায় করে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে হাজির হই। আমাকে ফিরে পেয়ে সবাই তখন উল্লাসে ফেটে পড়ে। আজো সেদিনের সেই বিভিষিকাময় স্মৃতিগুলো যেমনি করে কাঁদিয়ে বেড়ায় তেমনি স্বাধীনতা যুদ্ধে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় একজন যোদ্ধা হিসেবে নিজেকে গর্বিত বোধ করছি।