হযরত শাহজালাল (রঃ) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল চালু হলে বাড়বে বিমানের জ্বালানি জেট ফুয়েলের (জেট এ-১) চাহিদা। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) প্রাথমিক হিসাবে পুরোদমে চালুর পর দৈনিক বিক্রি ২ হাজার ৫০০ টনে পৌঁছতে পারে। বর্তমানে দৈনিক গড় বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৭০০ টন। থার্ড টার্মিনালে দৈনিক বিক্রি হতে পারে ৬০০ থেকে ৮০০ টন। সব মিলিয়ে সারা দেশের বিমানবন্দরগুলোতে তখন জেট ফুয়েলের দৈনিক বিক্রির পরিমাণ ২ হাজার ৫০০ টনে পৌঁছতে পারে।
বিপিসি সূত্র জানায়, থার্ড টার্মিনালের জেট ফুয়েলের বাড়তি চাহিদাকে সামনে রেখে নানা কার্যক্রম চলমান। এর মধ্যে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একটি নতুন স্টোরেজ ট্যাঙ্ক নির্মাণ করা হয়েছে। যেখানে বাড়তি জেট ফুয়েল মজুদ রাখা যাবে। অন্যদিকে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় অবস্থিত জ্বালানি তেলের মূল স্থাপনা বা মেইন ইনস্টলেশনে নতুন একটি জেট ফুয়েলের স্টোরেজ ট্যাঙ্ক নির্মাণের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল ডিপো থেকে সড়ক পথ এড়িয়ে সরাসরি জেট ফুয়েল শাহজালালে পরিবহনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য নারায়ণগঞ্জের পিতলগঞ্জ থেকে শাহজালাল বিমানবন্দরগামী একটি পাইপ লাইন নির্মাণকাজ শুরু করা হয়। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাজের গতি শ্লথ হওয়ায় পাইপ লাইনের নির্মাণকাজ থমকে আছে। বিপিসি নতুন করে ঠিকাদার নিয়োগের পরিকল্পনা নিয়েছে। এটি নির্মিত হলে গোদনাইল ডিপো থেকে দ্রুত এবং কম খরচে নিরাপদে জেট ফুয়েল সরবরাহ হবে ঢাকার অ্যাভিয়েশন ডিপোতে।
থার্ড টার্মিনাল চালুকে কেন্দ্র করে বাড়তি জেট ফুয়েল আমদানি করতে ইতিমধ্যে একটি প্রস্তাব বিপিসির বিপণন বিভাগ থেকে বাণিজ্যিক বিভাগের কাছে পাঠানো হয়েছে। বাড়তি জেট ফুয়েল আমদানির পরিকল্পনাও চূড়ান্ত করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বিপিসির পরিচালক (অপারেশন্স অ্যান্ড প্লানিং) অনুপম বড়ুয়া সময়ের আলোকে বলেন, থার্ড টার্মিনাল চালু হলে বিমানের জ্বালানি জেট ফুয়েলের চাহিদা বাড়বে। তাই বিদেশি সরবরাহকারীদের কাছ থেকে বাড়তি জেট ফুয়েল আমদানির জন্য একটি পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়েছে। যাতে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা যায়।
তিনি বলেন, থার্ড টার্মিনাল চালু হলে বিমান ওঠানামা বাড়বে। ফলে জেট ফুয়েলের বর্তমান চাহিদাও বাড়বে। টার্মিনালটি পুরোদমে চালু হলে প্রাথমিকভাবে ৩০০ থেকে ৫০০ টন দৈনিক বিক্রি বাড়বে। পুরোদমে চালু হলে দৈনিক বিক্রি আরও বাড়তে পারে। অন্যদিকে সড়ক পথে বাড়তি জেট ফুয়েল নিরাপদ এবং সহজে পরিবহন করতে বাড়ানো হচ্ছে ট্যাঙ্ক লরির ধারণক্ষমতা। বর্তমানে জেট ফুয়েল পরিবহন কাজে যুক্ত ১২৭টি ট্যাঙ্ক লরির প্রতিটির গড় জেট ফুয়েল ধারণক্ষমতা ৯ হাজার লিটার। এসব ট্যাঙ্ক লরির প্রতিটির স্টোরেজ ক্যাপাসিটি বা ধারণক্ষমতা ১৮ হাজার লিটারে উন্নীত করতে বিপিসি থেকে পদ্মা অয়েলকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ধারণক্ষমতা বাড়ানো সংক্রান্ত বিপিসির চিঠি গত মাসের মাঝামাঝি পদ্মা অয়েল কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে ধারণক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি নির্দেশনার বাস্তবায়ন কতটুকু হয়েছে তা বিপিসিকে অবহিত করতেও বলা হয়েছে।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বাড়তি জেট ফুয়েল রাখার জন্য স্টোরেজ ট্যাঙ্ক নির্মাণও শেষ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে পদ্মা অয়েলের উপ-মহাব্যবস্থাপক (অ্যাভিয়েশন) মোকসেদুল ইসলাম সময়ের আলোকে বলেন, তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে দৈনিক জেট ফুয়েলের চাহিদা বাড়বে। তাই বাড়তি জেট ফুয়েল রাখার জন্য ঢাকা বিমানবন্দরে স্টোরেজ ট্যাঙ্ক নির্মাণ করা হয়েছে।
বিপিসির কর্মকর্তারা জানান, বাড়তি চাহিদাকে সামনে রেখে নারায়ণগঞ্জের পিতলগঞ্জ থেকে শাহজালাল বিমানবন্দর পর্যন্ত একটি পাইপ লাইন নির্মাণকাজ শুরু করা হয়েছিল। এটি নির্মাণ শেষ করার পরিকল্পনা ছিল থার্ড টার্মিনালের কার্যক্রম শুরুর আগেই। পাইপ লাইনের মাধ্যমে সরাসরি জেট ফুয়েল যাবে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। আগে চট্টগ্রাম থেকে গোদনাইল ডিপোতে নৌপথে জেট ফুয়েল পরিবহন করা হতো অয়েল ট্যাঙ্কারের মাধ্যমে। এরপর সেখান থেকে সড়ক পথে প্রতিদিন গড়ে শতাধিক ট্যাঙ্ক লরিভর্তি জেট ফুয়েল পাঠানো হতো শাহজালাল বিমানবন্দরে পদ্মা অয়েল কোম্পানির অ্যাভিয়েশন ডিপোতে। বর্তমানে চট্টগ্রাম থেকে নৌপথে অয়েল ট্যাঙ্কারে জেট ফুয়েল নিয়ে যাওয়া হয় গোদনাইল ডিপোতে। পাইপ লাইন হলে আগের মতো গোদনাইল থেকে সড়ক পথে ঢাকায় জেট ফুয়েল পরিবহন করতে হবে না। সরাসরি পাইপ লাইনে পরিবহন করা হবে জেট ফুয়েল। আর পাইপ লাইনের মাধ্যমে যাওয়া জেট ফুয়েল ভর্তি করা হবে শাহজালাল বিমানবন্দরের স্টোরেজ ট্যাঙ্কে। তবে পাইপ লাইনটি নির্মাণ করতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। নতুন করে ঠিকাদার নিয়োগের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
ট্যাঙ্ক লরির ধারণক্ষমতা বাড়ানোর নির্দেশনা দেওয়া প্রসঙ্গে বিপিসির বিপণন বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, পাইপ লাইনে জেট ফুয়েল ঢাকার অ্যাভিয়েশন ডিপোতে এই মুহূর্তে পরিবহন হচ্ছে না। কারণ পাইপ লাইন নির্মাণ প্রকল্প শেষ হয়নি। তাই বাড়তি জেট ফুয়েল পরিবহনের জন্য আরও ট্যাঙ্ক লরি তালিকাভুক্ত করলে সড়কপথে সমস্যা তৈরি হবে। গোদনাইল ডিপো থেকে ঢাকার পথে ট্যাঙ্ক লরিগুলোর জট লেগে গেলে পরিবহন কাজও বিঘ্নিত হবে। তাই আপাতত নতুন ট্যাঙ্ক লরি যুক্ত না করে বিদ্যমান ট্যাঙ্ক লরির ধারণ ক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
পাইপ লাইন স্থাপন দেরী হচ্ছে : জেট ফুয়েল পরিবহনে নারায়ণগঞ্জের পিতলগঞ্জের কাঞ্চন সেতু থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কুর্মিটোলা অ্যাভিয়েশন ডিপো পর্যন্ত ভূ-গর্ভস্থ পাইপ লাইন স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিপিসির অর্থায়নে পাইপ লাইন স্থাপনের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। পরিবহনে ব্যয় হ্রাস, অপচয় ও সিস্টেম লস কমিয়ে আনতেই পাইপ লাইন স্থাপন পরিকল্পনা করা হয় বলে বিপিসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এই প্রকল্পের আওতায় পাম্পিং সুবিধাসহ ৮ ইঞ্চি ব্যাসবিশিষ্ট ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ জেট এ-১ পাইপ লাইন নির্মাণ করা হবে। প্রকল্প কাজ দেওয়া হয় ‘নৌ-কল্যাণ ফাউন্ডেশন ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে।
এ বিষয়ে বিপিসির পরিচালক অনুপম বড়ুয়া সময়ের আলোকে বলেন, একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে পাইপ লাইনটি নির্মাণের কাজ দেওয়া হয়েছিল। তারা কাজ শেষ করতে পারেনি। আমরা ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে নতুন একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছি। এ বিষয়ে কাজ চলছে। নতুন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ হলে পাইপ লাইন নির্মাণকাজ আবার শুরু হবে।
থার্ড টার্মিনাল চালুর আগে পাইপ লাইন চালু হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, এটি চালু হলে ঢাকার অ্যাভিয়েশন ডিপোতে বাড়তি জেট ফুয়েল দ্রুত সরবরাহ করা যেত। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতায় সেটি সময়মতো আর নির্মাণ করা যায়নি। নতুন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পাইপ লাইন স্থাপন কাজ দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করতে পারবে বলে আশা করি।
বাড়তি আমদানিতে বাধা ডলার সংকট : দেশে জেট ফুয়েল আমদানির পর বিক্রি করে লাভ করে আসছে বিপিসি। তাই জেট ফুয়েলের চাহিদা বাড়লে বিপিসি আমদানি বাড়াতে প্রস্তুতি নিয়েছে। তবে চলমান ডলার সংকটের কারণে আমদানি সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা নিয়ে দেখা দিয়েছে দুশ্চিন্তা। চলতি বছরের শুরুর দিকে আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে দেরী হওয়ায় জেট ফুয়েলের চালান চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছতে দেরী হয়। এতে দেশের বিমানবন্দরগুলোতে জেট ফুয়েলের ঘাটতি দেখা দেয়। তবে ওই সময় দ্রুত জেট ফুয়েল ভর্তি কয়েকটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে ভেড়ার পর ডিপোতে মজুদ সংকট কেটে যায়।
এ ব্যাপারে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিপিসির হিসাব বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, জেট ফুয়েল বিক্রি করে বিপিসি লাভ করে। কারণ এই ফুয়েল বিক্রি করার সময় আন্তর্জাতিক বাজারের দামের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়। তাই জেট ফুয়েল বিক্রিতে কোনো ধরনের লস নেই। এখন ডলার সংকটের কারণে বিদেশ থেকে জেট ফুয়েলের আমদানি প্রবাহ স্বাভাবিক রাখা নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তা আছে। তবে চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় করে জেট ফুয়েল আমদানি ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার পরিকল্পনা নেওয়া আছে।
লরির ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি নিয়ে হযবরল অবস্থা : বিপিসির নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে তেল কোম্পানি পদ্মার পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ট্যাঙ্ক লরি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে ধারণক্ষমতা বাড়াতে। ৯ হাজার লিটার ধারণক্ষমতার ট্যাঙ্ক লরিগুলো ১৮ হাজার লিটারে উন্নীত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নির্দেশনার পরও ধারণক্ষমতা বাড়ানোর কাজ শুরু হয়নি।
এ ব্যাপারে ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ সাজ্জাদুল করিম সময়ের আলোকে বলেন, আমরা নির্দেশনা অনুযায়ী ধারণক্ষমতা বাড়াতে চাই। কিন্তু পিতলগঞ্জ থেকে ঢাকা বিমানবন্দর পর্যন্ত জেট ফুয়েল পরিবহনে পাইপ লাইন স্থাপনের কাজ চলছে। পাইপে পরিবহন হলে ট্যাঙ্ক লরিগুলো অকেজো হয়ে যাবে। কোনো কাজে আসবে না এসব ট্যাঙ্ক লরি। তাই এখনই কেউ ধারণক্ষমতা বৃদ্ধির কাজ শুরু করেনি। তবে নির্দেশনা অনুসরণ করে আমরা কাজ করব।