Dhaka 11:03 pm, Saturday, 21 December 2024

চুরি ঠেকাতে তেল পরিবাহী গাড়িতে বসবে ডিভাইস

জ্বালানি তেল পরিবহনে চুরির অভিযোগ অনেক পুরনো। নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেও জ্বালানি চুরি বন্ধ করতে পারেনি সরকার; বছরের পর বছর বৈঠক আর নির্দেশনাই সার। জ্বালানিতেল পরিবহনে চুরি বন্ধে এবার তাই তেল পরিবাহী যানে স্মার্ট ফুয়েল ডিস্ট্রিবিউশন মনিটরিং সিস্টেম (এসএফডিএমএস) প্রযুক্তি স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) সূত্রে জানা যায়, এসএফডিএমএস ডিভাইস সংযোজনে ট্যাংকলরি অ্যাসোসিয়েশনের আগ্রহ নেই বরং আপত্তি রয়েছে। তবে সব ধরনের আপত্তি উপেক্ষা করে গাড়িগুলোতে ডিভাইস স্থাপনে তেল বিপণন কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের অনুরোধ করা হয়েছে। বিশেষ করে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা তেল কোম্পানির ব্যবস্থাপকদের বলা হয়েছে- তাদের তালিকাভুক্ত ট্যাংকলরিতে স্মার্ট ফুয়েল ডিস্ট্রিবিউশন মনিটরিং সিস্টেম স্থাপন করতে।

এ বিষয়ে জ্বালানি বিভাগে সম্প্রতি এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বিপিসির পরিচালক বিপণন জানান, ডিভাইস ইনস্টলের পাশাপাশি দ্রুত একটি সফটওয়্যার ডেভেলপ করতে হবে। এ কর্মকর্তা মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে ৬৬টি ট্যাংকলরিতে ট্র্যাকিং ডিভাইস স্থাপন করা হয়েছে। তবে তেল বিপণন কোম্পানির তালিকাভুক্ত সব গাড়িতেই এ ট্র্যাকিং স্থাপনের সিদ্ধান্ত রয়েছে।

উল্লেখ্য, বিপিসির আওতাভুক্ত তেল বিপণন কোম্পানিগুলোতে বছরের পর বছর ধরে নানা চেষ্টা-উদ্যোগেও তেল চুরি ঠেকানো যায়নি। মাদার ভেসেল থেকে বিপণন কোম্পানির রিজার্ভ ট্যাংকারে তেল পরিবহনের সময় চুরি ঘটছে। রিজার্ভ ট্যাংক থেকে দেশের বিভিন্ন ডিপোতে তেল পৌঁছানোর সময়, ডিপো থেকে এয়ারপোর্টসহ বিভিন্ন গন্তব্যে তেল পৌঁছানোর সময়ও ও একই কাণ্ড ঘটছে।

বিপিসির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর হতে না পারলে এ চুরি কারও পক্ষেই ঠেকানো সম্ভব নয়। এ কর্মকর্তা বলেন, দেশের প্রতিটি ডিপো এলাকাকে কেন্দ্র করে যারা জ্বালানিতেলের ব্যবসা করেন তাদের একাংশ এবং ডিপোকেন্দ্রিক কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে এসব চুরি হয়ে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলো সিস্টেম লস বা অপারেনাল ক্ষতি হিসাবে সমন্বয় করা হয়।

মেঘনা তেল বিপণন কোম্পানির এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, এমন অভিযোগও রয়েছে যে, দামের পার্থক্যকে কাজে লাগিয়ে অকটেনের রিজার্ভ ট্যাংকে ডিজেল মিশিয়ে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। এটা এমন অনুপাতে মিশিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে যে, খুব সহজে ধরা যাচ্ছে না। এ কর্মকর্তা বলেন, এর পরিমাণ লাখ লাখ লিটার। এগুলোর সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালীসহ প্রশাসনও জড়িয়ে পড়েছে। তেলের বিপণন ও বাণিজ্যিকীকরণ যদি পুরোপুরি প্রযুক্তিনির্ভর করা যায়, তাহলে চুরির পরিমাণ কমে আসবে।

উল্লেখ্য, সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের কর্মকর্তারাও তেল চুরিসহ এসব অপকর্মের বিষয়টি জানেন। বিভিন্ন সময় নানা কৌশলে এগুলো বন্ধ করার চেষ্টাও চলেছে। চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল এবং গোদনাইল থেকে ফতুল্লা পর্যন্ত জ্বালানিতেলের পাইপলাইন করার অন্যতম একটি উদ্দেশ্য সহজে সরবরাহ করা। এ ছাড়া চুরি ঠেকাতেও এ উদ্যোগ নেওয়া হয়।

এদিকে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরাও মনে করেন, আধুনিক মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকায় বিপিসি বছরের পর বছর লোকসানের ঘানি টানছে। চুরি বন্ধ করা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে জ্বালানিবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম আমাদের সময়কে বলেন, বিপিসি অনেকটা ফ্রি স্টাইলে চলছে। তাদের হিসাবে ঝামেলা আছে। তারা লাভ ক্ষতির সুস্পষ্ট হিসাব কখনো দেয় না। তিনি বলেন, সব ক্ষেত্রে প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থা না করলে বিপিসির চুরি বন্ধ হবে না। এক সেমিনারে তিনি এও বলেন যে, বিপিসি এখন জ্বালানিতেল সমন্বয়ের মাধ্যমে মূলত দুর্নীতির সমন্বয় করছে।

এদিকে চলতি বছরের মার্চ মাসে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় পদ্মা অয়েলের প্রধান স্থাপনা পরিদর্শনকালে বলেছেন, জ্বালানিতেল ব্যবস্থাপনায় অটোমেশন সময়ের দাবি। তেল কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবশ্যই আধুনিক ধ্যান-ধারণাসম্পন্ন হতে হবে। াশাপাশি তেল পরিবহন ব্যবস্থাও হতে হবে আন্তর্জাতিক মানের।

এদিকে বিপিসির কর্মকর্তারা বারবার বলে আসছেন, জ্বালানি তেল খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি ও সিস্টেম লস কমাতে বিপিসি জ্বালানি তেল পরিবহন ও বিপণন ব্যবস্থা অটোমেশনের আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে। প্রাথমিকভাবে বিপিসির চট্টগ্রামের পতেঙ্গার প্রধান তেল স্থাপনাগুলোকে অটোমেশনের আওতায় আনা হবে। পর্যায়ক্রমে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েলের ডিপো পর্যায়েও সব কাজ অটোমেশনে চলবে। এতে বিপিসির লোকসান বন্ধ হবে, সাশ্রয় হবে কয়েকশ কোটি টাকা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বিপণন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমাদের সময়কে বলেন, দেশের জ্বালানি তেল সেক্টরের অটোমেশনের জন্য ইতিপূর্বে চেষ্টা চালানো হয়েছিল। কিন্তু তা বিভিন্ন বাধার কারণে মাঝপথে আটকে যায়। সম্প্রতি জ্বালানি তেল চুরি ও পাচারের একাধিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিপিসির পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠানটির আওতাধীন পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েল কোম্পানিকে অটোমেশন দ্রুত কার্যকর করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমরাও চেষ্টা করছি। খুব শিগগিরই এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হবে বলে আমরা আশা করছি।

ট্যাগস :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয়
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com

চুরি ঠেকাতে তেল পরিবাহী গাড়িতে বসবে ডিভাইস

আপলোড সময় : 08:06:33 pm, Tuesday, 9 July 2024

জ্বালানি তেল পরিবহনে চুরির অভিযোগ অনেক পুরনো। নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেও জ্বালানি চুরি বন্ধ করতে পারেনি সরকার; বছরের পর বছর বৈঠক আর নির্দেশনাই সার। জ্বালানিতেল পরিবহনে চুরি বন্ধে এবার তাই তেল পরিবাহী যানে স্মার্ট ফুয়েল ডিস্ট্রিবিউশন মনিটরিং সিস্টেম (এসএফডিএমএস) প্রযুক্তি স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) সূত্রে জানা যায়, এসএফডিএমএস ডিভাইস সংযোজনে ট্যাংকলরি অ্যাসোসিয়েশনের আগ্রহ নেই বরং আপত্তি রয়েছে। তবে সব ধরনের আপত্তি উপেক্ষা করে গাড়িগুলোতে ডিভাইস স্থাপনে তেল বিপণন কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের অনুরোধ করা হয়েছে। বিশেষ করে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা তেল কোম্পানির ব্যবস্থাপকদের বলা হয়েছে- তাদের তালিকাভুক্ত ট্যাংকলরিতে স্মার্ট ফুয়েল ডিস্ট্রিবিউশন মনিটরিং সিস্টেম স্থাপন করতে।

এ বিষয়ে জ্বালানি বিভাগে সম্প্রতি এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বিপিসির পরিচালক বিপণন জানান, ডিভাইস ইনস্টলের পাশাপাশি দ্রুত একটি সফটওয়্যার ডেভেলপ করতে হবে। এ কর্মকর্তা মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে ৬৬টি ট্যাংকলরিতে ট্র্যাকিং ডিভাইস স্থাপন করা হয়েছে। তবে তেল বিপণন কোম্পানির তালিকাভুক্ত সব গাড়িতেই এ ট্র্যাকিং স্থাপনের সিদ্ধান্ত রয়েছে।

উল্লেখ্য, বিপিসির আওতাভুক্ত তেল বিপণন কোম্পানিগুলোতে বছরের পর বছর ধরে নানা চেষ্টা-উদ্যোগেও তেল চুরি ঠেকানো যায়নি। মাদার ভেসেল থেকে বিপণন কোম্পানির রিজার্ভ ট্যাংকারে তেল পরিবহনের সময় চুরি ঘটছে। রিজার্ভ ট্যাংক থেকে দেশের বিভিন্ন ডিপোতে তেল পৌঁছানোর সময়, ডিপো থেকে এয়ারপোর্টসহ বিভিন্ন গন্তব্যে তেল পৌঁছানোর সময়ও ও একই কাণ্ড ঘটছে।

বিপিসির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর হতে না পারলে এ চুরি কারও পক্ষেই ঠেকানো সম্ভব নয়। এ কর্মকর্তা বলেন, দেশের প্রতিটি ডিপো এলাকাকে কেন্দ্র করে যারা জ্বালানিতেলের ব্যবসা করেন তাদের একাংশ এবং ডিপোকেন্দ্রিক কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে এসব চুরি হয়ে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলো সিস্টেম লস বা অপারেনাল ক্ষতি হিসাবে সমন্বয় করা হয়।

মেঘনা তেল বিপণন কোম্পানির এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, এমন অভিযোগও রয়েছে যে, দামের পার্থক্যকে কাজে লাগিয়ে অকটেনের রিজার্ভ ট্যাংকে ডিজেল মিশিয়ে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। এটা এমন অনুপাতে মিশিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে যে, খুব সহজে ধরা যাচ্ছে না। এ কর্মকর্তা বলেন, এর পরিমাণ লাখ লাখ লিটার। এগুলোর সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালীসহ প্রশাসনও জড়িয়ে পড়েছে। তেলের বিপণন ও বাণিজ্যিকীকরণ যদি পুরোপুরি প্রযুক্তিনির্ভর করা যায়, তাহলে চুরির পরিমাণ কমে আসবে।

উল্লেখ্য, সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের কর্মকর্তারাও তেল চুরিসহ এসব অপকর্মের বিষয়টি জানেন। বিভিন্ন সময় নানা কৌশলে এগুলো বন্ধ করার চেষ্টাও চলেছে। চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল এবং গোদনাইল থেকে ফতুল্লা পর্যন্ত জ্বালানিতেলের পাইপলাইন করার অন্যতম একটি উদ্দেশ্য সহজে সরবরাহ করা। এ ছাড়া চুরি ঠেকাতেও এ উদ্যোগ নেওয়া হয়।

এদিকে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরাও মনে করেন, আধুনিক মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকায় বিপিসি বছরের পর বছর লোকসানের ঘানি টানছে। চুরি বন্ধ করা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে জ্বালানিবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম আমাদের সময়কে বলেন, বিপিসি অনেকটা ফ্রি স্টাইলে চলছে। তাদের হিসাবে ঝামেলা আছে। তারা লাভ ক্ষতির সুস্পষ্ট হিসাব কখনো দেয় না। তিনি বলেন, সব ক্ষেত্রে প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থা না করলে বিপিসির চুরি বন্ধ হবে না। এক সেমিনারে তিনি এও বলেন যে, বিপিসি এখন জ্বালানিতেল সমন্বয়ের মাধ্যমে মূলত দুর্নীতির সমন্বয় করছে।

এদিকে চলতি বছরের মার্চ মাসে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় পদ্মা অয়েলের প্রধান স্থাপনা পরিদর্শনকালে বলেছেন, জ্বালানিতেল ব্যবস্থাপনায় অটোমেশন সময়ের দাবি। তেল কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবশ্যই আধুনিক ধ্যান-ধারণাসম্পন্ন হতে হবে। াশাপাশি তেল পরিবহন ব্যবস্থাও হতে হবে আন্তর্জাতিক মানের।

এদিকে বিপিসির কর্মকর্তারা বারবার বলে আসছেন, জ্বালানি তেল খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি ও সিস্টেম লস কমাতে বিপিসি জ্বালানি তেল পরিবহন ও বিপণন ব্যবস্থা অটোমেশনের আওতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে। প্রাথমিকভাবে বিপিসির চট্টগ্রামের পতেঙ্গার প্রধান তেল স্থাপনাগুলোকে অটোমেশনের আওতায় আনা হবে। পর্যায়ক্রমে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েলের ডিপো পর্যায়েও সব কাজ অটোমেশনে চলবে। এতে বিপিসির লোকসান বন্ধ হবে, সাশ্রয় হবে কয়েকশ কোটি টাকা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বিপণন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমাদের সময়কে বলেন, দেশের জ্বালানি তেল সেক্টরের অটোমেশনের জন্য ইতিপূর্বে চেষ্টা চালানো হয়েছিল। কিন্তু তা বিভিন্ন বাধার কারণে মাঝপথে আটকে যায়। সম্প্রতি জ্বালানি তেল চুরি ও পাচারের একাধিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিপিসির পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠানটির আওতাধীন পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েল কোম্পানিকে অটোমেশন দ্রুত কার্যকর করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমরাও চেষ্টা করছি। খুব শিগগিরই এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হবে বলে আমরা আশা করছি।