প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার দিনের সফরে আজ সোমবার চীনের রাজধানী বেইজিং যাচ্ছেন। গত জানুয়ারির বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের পর সরকারপ্রধান পর্যায়ে এটিই প্রথম চীন সফর। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ গতকাল রবিবার ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে জানান, প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন চীন সফরে ২০টি সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে।
তিস্তা প্রকল্পে ভারতের যুক্ত হওয়ার প্রস্তাবের বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তিস্তা বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ নদী।
ফলে তিস্তা নিয়ে ভারতের প্রস্তাব আগে িবেচনা করতে হবে। চীনের পক্ষ থেকে তিস্তা প্রকল্প প্রসঙ্গ তোলা হলে সে বিষয়েও আলোচনা হবে।
মন্ত্রী বলেন, তিস্তা নিয়ে এরই মধ্যে ভারত একটি প্রস্তাব দিয়েছে। বাংলাদেশ ওই প্রস্তাবকে স্বাগত জানায়।
এ ছাড়া বাংলাদেশে তারা একটি টেকনিক্যাল টিম পাঠাবে বলেও জানিয়েছে।
চীন সফরে দুই দেশের বাণিজ্যিক চুক্তিগুলোকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘চীনে আমরা রপ্তানি বাড়াতে চাই। বিশেষ করে কৃষিপণ্যসহ অন্যান্য পণ্য রপ্তানিতে যেসব শুল্ক বাধা আছে, তা নিয়ে আলোচনা করা হবে। এ ছাড়া অতীতের যেসব চুক্তি এখনো বাস্তবায়িত হয়নি, সেগুলো নিয়ে আলোচনা অব্যাহত থাকবে।
চীনের সহযোগিতায় আমাদের পূর্ব উন্নয়ন ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে আলোচনাও চলমান থাকবে।’
চীন থেকে আমরা কী পরিমাণ ঋণ পেতে পারি, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘এই সফরে ঋণের বিষয়ে কোনো কর্মকাণ্ড নেই। এ নিয়ে দুই দেশের আলোচনা হতে পারে। তবে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই।’
তিনি বলেন, ‘নানা দেশ বিভিন্ন সময় ঋণ প্রস্তাব দিয়ে থাকে।
সব ঋণ নয়, বরং প্রয়োজনীয়তার নিরিখে আমরা ঋণগুলো গ্রহণ করি। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন করতে চেয়েও ফেরত গেছে। পরে তারা আবার অর্থায়ন করতে চাইলেও আমরা তা নিইনি।’
বাংলাদেশে সরবরাহ করা চীনের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম নিম্নমানের—এমন অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘গণমাধ্যমে এমন খবর এসেছে। এ বিষয়ে মন্তব্য করার আগে বিষয়টি আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, চীনের রাষ্ট্রীয় কাউন্সিলের প্রিমিয়ার লি ছিয়াংয়ের আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী ৮ থেকে ১১ জুলাই চীন সফর করবেন। র্থমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী, পররাষ্ট্রসচিবসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সচিব, উচ্চ পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হবেন।
প্রধানমন্ত্রী আজ সকাল ১১টায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনেসর বিশেষ ফ্লাইটযোগে ঢাকা ছাড়বেন। আজ চীনের স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টায় (বাংলাদেশ সময় বিকেল ৪টায়) বেইজিং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করবেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রীকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করা হবে এবং যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে তাঁকে অভ্যর্থনা জানানো হবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, আগামীকাল মঙ্গলবার সকালে প্রধানমন্ত্রী এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিন লিকুনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। সেদিন প্রধানমন্ত্রী সাং-গ্রি-লা সার্কেলে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে ব্যবসা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্ভাবনা বিষয়ক শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেবেন। ওই সম্মেলনে অংশ নিতে বাংলাদেশ থেকে একটি ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল চীন সফর করবে।
সফরসূচি অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী আগামীকাল দুপুরে চীনা পিপলস পলিটিক্যাল কনসালটেটিভ কনফারেন্সের (সিপিপিসিসি) ১৪তম জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান ওয়াং হানিংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন। বিকেলে প্রধানমন্ত্রী ঐতিহ্যবাহী তিয়ানআনমেন স্কয়ারে শ্রদ্ধা জানাবেন। রাতে তিনি বেইজিংয়ে বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজিত নৈশভোজে অংশ নেবেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সফরের তৃতীয় দিন আগামী বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্রেট হল অব দ্য পিপলে চীনের প্রিমিয়ার লি ছিয়াংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। সাক্ষাতের শুরুতে প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে একটি অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। গ্রেট হলে প্রধানমন্ত্রী ও চীনের প্রিমিয়ার দুই দেশের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদলসহ দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন। এরপর দুই দেশের সরকারপ্রধানের উপস্থিতিতে প্রায় ২০টির মতো সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত এবং কিছু প্রকল্প উদ্বোধনের ঘোষণা দেওয়া হতে পারে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, অর্থনৈতিক ও ব্যাংকিং খাত, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, ডিজিটাল ইকোনমি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি খাতে সহায়তা, ষষ্ঠ ও নবম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু নির্মাণ, বাংলাদেশ থেকে কৃষিপণ্য রপ্তানি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, মানুষে-মানুষে যোগাযোগ ইত্যাদি বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের সম্ভাবনা আছে। প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে আয়োজিত ব্যাংকুয়েটের (ভোজের) মাধ্যমে গ্রেট হলে সাক্ষাতের আনুষ্ঠিকতা সম্পন্ন হবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আগামী বুধবার বিকেলে প্রধানমন্ত্রী গ্রেট হলে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন। প্রধানমন্ত্রীর এই সফর উপলক্ষে বাংলাদেশ ও চীন একটি যৌথ বিবৃতি দেবে।
সফর শেষে প্রধানমন্ত্রী আগামী বৃহস্পতিবার সকালে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বিশেষ ফ্লাইটে চীন ত্যাগ করবেন এবং দুপুর ২টায় ঢাকায় পৌঁছবেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ-চীন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সূচনা হয়েছিল স্বাধীনতারও আগে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৫২ সালে ঐতিহাসিক চীন সফরের মাধ্যমে, যে সময় চীনের তৎকালীন নেতা মাও জেদংয়ের সঙ্গে জাতির জনকের সাক্ষাৎ হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে বঙ্গবন্ধু রচনা করেন ‘আমার দেখা নয়াচীন’ বইটি। চীন ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এর ধারাবাহিকতায় দুই দেশ পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে উন্নয়নের পথে অগ্রসরমাণ আছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ২০১৬ সালে শি চিনপিংয়ের ঢাকা সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক ‘ৌশলগত সহযোগিতার অংশীদারি’তে উন্নীত হয়। গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীকে চীনের পক্ষ থেকে সরকারি সফরের জন্য আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানানো হয়। চীন বাংলাদেশের অবকাঠামোগত এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হিসেবে কাজ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ।
ড. হাছান মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য, আর্থিক সহায়তা এবং বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে বাংলাদেশ চীনের সহায়তা কামনা করবে। একই সঙ্গে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে চীনের বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ চীনকে সমর্থন দিয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রীর এই সফর সফল ও ফলপ্রসূ হবে বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন।