বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমেছে। এর ধারাবাহিকতায় মুনাফায় ফিরেছে জ্বালানি তেল আমদানি ও বিপণনে নিয়োজিত রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। সংস্থাটির কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অর্থ মন্ত্রণালয় হিসাব করে দেখেছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে সংস্থাটির নিট মুনাফা হবে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। যদিও চলতি অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের সময় প্রক্ষেপণ করা হয়েছিল ২০২৩-২৪-এ ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি লোকসান করতে পারে বিপিসি।
সম্প্রতি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট চূড়ান্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরে বিপিসির মোট বিক্রি দাঁড়াতে পারে ৭৭ লাখ ৭০ হাজার ৯৫৫ টনে, যার অর্থমূল্য ৮৪ হাজার ২৫৩ কোটি ৯১ লাখ টাকা। আগের অর্থবছরে সংস্থাটি জ্বালানি তেল ও অন্যান্য পণ্য বিক্রি করেছিল ৭২ লাখ ৯৮ হাজার ৮৯৩ টন। টাকার অংকে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৭৯ হাজার ১৮৭ কোটি ৫১ লাখ টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যারেলপ্রতি ৯৬ ডলার ৬৫ সেন্ট মূল্যে অপরিশোধিত তেল আমদানি করেছিল বিপিসি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের চলতি বছরের হিসাবে এর ব্যারেলপ্রতি মূল্য ধরা হয়েছে ১০৩ ডলার ৪৮ সেন্ট।
চলতি অর্থবছরে সংস্থাটির বিক্রীত পণ্যের মোট (পরিচালন) ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৯ হাজার ৬১৯ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এর আগে তা ১ লাখ ১২ হাজার ৭৯ কোটি ১০ লাখ টাকায় দাঁড়াতে পারে বলে প্রাক্কলন করেছিল মন্ত্রণালয়। গত অর্থবছরে বিপিসির এ বাবদ মোট ব্যয় ছিল ৭৩ হাজার ৩২৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। আয়ের তুলনায় ব্যয় কমায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিপিসির মোট পরিচালন উদ্বৃত্ত হিসাব করা হয়েছে ৪ হাজার ৬৩৪ কোটি ২২ লাখ টাকা। এর আগে এ বাবদ ৯ হাজার ২৭৩ কোটি ৫৭ লাখ টাকা পরিচালন লোকসানের প্রাক্কলন করা হয়েছিল। গত অর্থবছরে সংস্থাটির পরিচালন উদ্বৃত্ত ছিল ৫ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা।
সব মিলিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে বিপিসির নিট মুনাফা হতে পারে ৩ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা। যদিও শুরুতে ১০ হাজার ১৯ কোটি টাকা নিট লোকসানের প্রাক্কলন করা হয়েছিল। আর গত অর্থবছরে সংস্থাটির নিট মুনাফা হয়েছিল ৪ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিপিসির চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাজেট প্রণয়নের কয়েক মাস আগে থেকেই বিপিসির কাছ থেকে জ্বালানির দাম কেমন হতে পারে সে হিসাব নিয়ে বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয়ে থাকে। সে সময় বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেশি ছিল বিধায় বিপিসির লোকসান হবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছিল। তবে যখন চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট করা হয় সে সময়ের মধ্যে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে এসেছে। ফলে বিপিসি বর্তমানে মুনাফায় রয়েছে। তবে এখনো অর্থবছর শেষ হয়নি। সামনে যদি বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বেড়ে যায়, তাহলে পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে পারে।’
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় ভর্তুকির চাপ এড়াতে ২০২২ সালের ৫ আগস্ট গড়ে ৪২ শতাংশ বাড়ানো হয় জ্বালানি তেলের দাম। সেই সময় ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৮০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়। অকটেনের দাম ৮৯ থেকে বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা আর পেট্রলের দাম ৮৬ থেকে বাড়িয়ে ১৩০ টাকা করা হয়। এরপর ব্যাপক সমালোচনার মুখে ২৩ দিনের মাথায় সব জ্বালানি তেলের দাম লিটারে ৫ টাকা করে কমানো হয়। এ বছরের ৭ মার্চ বিশ্ববাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি চালু করে সরকার। দেশে প্রথমবারের মতো স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণের ঘোষিত প্রজ্ঞাপনে জ্বালানি তেলের দাম সামান্য কমিয়েছিল সরকার। ওই সময় প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনে ১০৯ টাকা থেকে ৭৫ পয়সা কমিয়ে ১০৮ টাকা ২৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। অকটেনের দাম ১৩০ টাকা থেকে কমিয়ে ১২৬ টাকা এবং পেট্রলের দাম ১২৫ টাকা থেকে কমিয়ে ১২২ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
সর্বশেষ গত ১ এপ্রিল থেকে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ২ টাকা ২৫ পয়সা কমিয়ে লিটারপ্রতি ১০৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে অপরিবর্তিত রয়েছে পেট্রল ও অকটেনের দাম। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সময় বিপিসির পক্ষ থেকে জানানো হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ৮ হাজার কোটি টাকা লোকসান হয়েছে সংস্থাটির। ওই লোকসান কমাতে দাম বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল।
দেশে ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রল ও অকটেনের দাম নির্ধারণ করে জ্বালানি বিভাগ। এছাড়া উড়োজাহাজে ব্যবহৃত জেট ফুয়েল ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহৃত ফার্নেস অয়েলের দাম নিয়মিত সমন্বয় করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। যদিও আইনে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) মাধ্যমে গণশুনানিতে জ্বালানির দাম বাড়ানোর বিধান রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে বিইআরসির বিধি অনুমোদন না হওয়ার কারণে সরকারই জ্বালানির দাম নির্ধারণ করে আসছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে সাত কিস্তিতে ৪২ মাসে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণের জন্য গত বছরের জানুয়ারিতে সরকারের সঙ্গে সংস্থাটির চুক্তি হয়। এ ঋণের বিপরীতে বিভিন্ন ধরনের শর্ত পরিপালন ও সংস্কার করতে হবে বাংলাদেশকে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ কমিয়ে আনার মাধ্যমে সরকারের ব্যয় সক্ষমতা বাড়ানো। জ্বালানি পণ্যের দাম সমন্বয়ে একটি সময়ভিত্তিক মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি চালুর শর্ত ছিল আইএমএফের। এর মাধ্যমে ঋণ কর্মসূচি চলাকালে দেশে জ্বালানি পণ্যে কাঠামোগত ভর্তুকির পরিমাণ শূন্যে নামিয়ে আনতে বলেছে সংস্থাটি। এরই ধারাবাহিকতায় সরকার জ্বালানিতে ভর্তুকি প্রত্যাহার করে বাজারভিত্তিক মূল্য নির্ধারণের পদ্ধতি চালু করেছে।
জানতে চাইলে আইএমএফের সাবেক অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মাঝে জ্বালানি তেলের দাম ৯০ থেকে ৯৫ ডলারে উঠে গিয়েছিল। পরে অবশ্য দাম কমে ৭৫ ডলারে নেমে আসে। এতে জ্বালানি তেল বিক্রি করে বিপিসি মুনাফা করেছে। বর্তমানে জ্বালানি তেলের দাম কিছুটা বেড়ে ৮৫ ডলার হয়েছে। এতে বিপিসি ব্রেক ইভেনে আছে বলে আমি মনে করি। সংশোধিত বাজেটে লোকসানের পরিবর্তে বিপিসির মুনাফা থাকার বিষয়টি ইতিবাচক। এতে প্রতিষ্ঠানটিকে ভর্তুকি দেয়ার প্রয়োজন হবে না, যা সরকারের মূল্যবান অর্থ সাশ্রয় করবে। আমরা যে সরকারকে ১ লাখ কোটি টাকা ব্যয় কমানোর পরামর্শ দিয়েছি, সেক্ষেত্রে এটি সহায়ক হবে। আইএমএফের শর্তের কারণে জ্বালানি তেলের দাম বাজারভিত্তিক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। আশা করব সামনের দিনগুলোয়ও জ্বালানি তেলের দাম বাজারভিত্তিক থাকবে এবং বিপিসিকে লোকসান গুনতে হবে না। তবে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণের পদ্ধতিটি স্বচ্ছ করা উচিত। কীভাবে দর নির্ধারণ করা হচ্ছে, সেটির বিস্তারিত জানানো উচিত। তাছাড়া জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণের বিষয়টি বিইআরসির কাছে ফিরিয়ে দেয়া উচিত। এতে জনগণ ও অংশীজনদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে, যা শেষ পর্যন্ত সরকারের জন্যই ভালো হবে।’
দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদার মাত্র ৮ শতাংশ পূরণ হয় স্থানীয় উৎস থেকে। বাকি চাহিদার পুরোটাই পূরণ হয় আমদানির মাধ্যমে। বিপিসি অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে দুটি দেশ থেকে। এ দুই দেশের সরবরাহকারী দুই প্রতিষ্ঠান হলো সৌদি আরবভিত্তিক সৌদি আরামকো ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) আবুধাবি ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি লিমিটেড। এর বাইরে আটটি দেশ থেকে জিটুজি চুক্তির মাধ্যমে পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়। ভোক্তা পর্যায়ে পেট্রোলিয়াম পণ্যের মধ্যে এখন ডিজেলের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি পরিবহন খাতেও জ্বালানি হিসেবে পণ্যটির ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। এইচএফও বা ফার্নেস অয়েল ব্যবহার হচ্ছে শিল্প ও পরিবহন খাতে।