গ্যাস খাতে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে আমূল সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। এর লক্ষ্য সিস্টেম লস কমানো, গ্যাসের চুরি ও অপচয় ঠেকানো এবং সরবরাহ ও গ্রাহক পর্যায়ে ব্যবহারের মধ্যে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। পেট্রোবাংলা মনে করছে, এর আওতাধীন কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনা গতানুগতিক হওয়ায় অনিয়মে কাউকে দায়বদ্ধ করা যাচ্ছে না। ফলে সংস্কার এনে প্রতিটি এলাকায় গ্যাসের সরবরাহ, ব্যবহার বা সিস্টেম লস-গেইনের হিসাবও বের করতে চায় তারা।
দেশীয় উৎস থেকে উৎপাদিত গ্যাস এবং বিদেশ থেকে আমদানিকৃত গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহ পয়েন্ট থেকে শুরু করে গ্রাহক পর্যন্ত পৌঁছাতে কাজ করছে পেট্রোবাংলার কোম্পানিগুলো। এসব কোম্পানি পরিচালনায় ইতোমধ্যে সংস্কার উদ্যোগ গ্রহণ করে কাজ শুরু করে দিয়েছে সংস্থাটি।
গ্যাস সরবরাহের প্রতিটি পর্যায়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও ব্যবহার নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যে চারটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করে দিয়েছে পেট্রোবাংলা। এ ছাড়া রয়েছে কেন্দ্রীয় ভিজিল্যান্স টিম। সংস্থাটির
উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা মনে করছেন, কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এমন এক প্রক্রিয়ার মধ্যে কাজ করছেন যেখানে প্রকৃত অর্থে জবাবদিহিতা নেই। বছরের পর বছর গড়পড়তা কাজ করার ফলে গ্যাস সেক্টর বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। সিস্টেম লসের নামে গ্যাসের অপব্যহার, গ্যাসের চুরি জায়েজ হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া কোন কোন সেক্টরের কর্মকর্তা কর্মচারীরা বিরামহীন কাজ করছেন আবার কোন কোন সেক্টরের কর্মকর্তা কর্মচারীরা বছরের পর বছর তেমন কাজই করছেন না। ফলে গ্যাস খাতে একটা আমূল সংস্কার করতে চায় পেট্রোবাংলা।
পেট্রোবাংলা চায় গ্যাসের ব্যবহার প্রতিটি পর্যায়ে মনিটরিং হবে। প্রতিটি এলাকায় গ্যাসের সরবরাহ, ব্যবহার এবং সেখান থেকে আদায়কৃত রাজস্বের হিসাব হবে। এলাকাভিত্তিক মিটারিং এবং সিস্টেম লস নির্ধারণ করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জবাবদিহিতার মধ্যে আনা হবে।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, একটি সঞ্চালন কোম্পানির মাধ্যমে ছয়টি বিতরণ কোম্পানিতে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ (জিটিসিএল) পয়েন্ট থেকে মিটার বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন কোন কোম্পানিতে কতটুকু গ্যাস সরবরাহ করা হয় সেটার একটা হিসাব রাখা যায়। কিন্তু গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো তাদের অভ্যন্তরে কোন এলাকায় কতটুকু গ্যাস ব্যবহার করছে সেটা এখনো নির্ধারণ করা যায়নি।
পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন) মো. কামরুজ্জামান আমাদের সময়কে বলেন, আমরা একটা ভালো কোম্পানি এবং একটা খারাপ কোম্পানির মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণ করছি। যে কোম্পানি ভালো করল সে কেন করল সেটা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। জালালাবাদ এবং পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানিকে আইডল নির্ধারণ করা হয়েছে। শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, শাহীবাজার আলাদা আলাদা নেটওয়ার্ক, আলাদা গ্যাস স্টেশন, আলাদা আলাদা এরিয়া থাকায় সেখানে কত গ্যাস নেয় এবং কত ব্যবহার হয় সেটা ভালোভাবে নির্ধারণ করা হচ্ছে। সেখানে ম্যানেজমেন্টও ভালো।
তিতাসের আওতাধীন এলাকায় নেটওয়ার্ক সমস্যা রয়েছে বলে জানান মো. কামরুজ্জামান। তিনি বলেন, একদিকের গ্যাস অন্যদিকে সরবরাহ করা হচ্ছে। আলাদা আলাদা স্টেশন নেই। নেটওর্য়াক একাকার করে ফেলছে। এখন একজন আরেকজনের দোষ দেয়। তিনি বলেন, এখন থেকে প্রতিমাসে মার্কেটিং অপারেশন ও পরিকল্পনা বিভাগকে তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে পেট্রোবাংলাকে অবহিত করতে হবে। এলাকাভিত্তিক গ্যাসের হিসাব নিরূপণ করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, প্রতিটি এলাকার আলাদা আলাদা ডিআরএস ডিস্ট্রিক্ট রেগুলেটরি স্টেশন বা ডিস্ট্রিবিউশন রেগুলেটরি স্টেশন স্থাপন করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্ল্যানিং, অপারেশন, মার্কেটিং সব বিভাগকে এক সঙ্গে কাজ করতে বলা হয়েছে। যাতে করে এক বিভাগ দায় এড়াতে অন্য বিভাগের ওপর দোষ দিতে না পারে।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, সিস্টেম লস নিয়ন্ত্রণ ও হ্রাস করতে কোম্পানিগুলোর ইনটেক ও অফটেক গ্যাস মিটারিং ব্যবস্থা চালু করতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে বাল্ক গ্রাহকদের মিটারিং ব্যবস্থা মনিটর করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া সামগ্রিক বিষয়ে মনিটর করতে টপ সুপারভাইজার কমিটি গঠন করা হয়েছে। রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে প্রধান করে ১৯ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেখানে পেট্রোবাংলার দুজন মহাব্যবস্থাপক রয়েছে। এ ছাড়া ১১টি কোম্পানি অপারেশন শাখার মহাব্যবস্থাপক এবং পেট্রোবাংলার উপমহাব্যবস্থাপক ও ব্যবস্থাপক ও সহকারী ব্যবস্থাপক পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে।
এদিকে আরও তিনটি কমিটি গঠন করা হয়েছে যার মধ্যে একটি হলো জিটিসিএলের অফট্রান্সমিশন-বিতরণ কোম্পানির ইনটেক-বাল্ক গ্রাহকের সরাসরি উৎস হতে গ্যাস গ্রহণ ও আওতাধীন এলাকায় গ্রাহকদের নিকট বিক্রয়ের মিটারিং, সিস্টেম লস নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। পেট্রোবাংলার মহাব্যবস্থাপককে (উৎপাদন ও বিতরণ) প্রধান করে ১৬ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। যেখানে সাতটি কোম্পানির কর্মকর্তা, কর্মচারী ও পেট্রোবাংলার একাধিক কর্মকর্তা রয়েছেন।
পেট্রোবাংলার অধীনে মোট ১৩টি কোম্পানি রয়েছে যার মধ্যে তিনটি গ্যাস অনুসন্ধান করে। একটি কোম্পানি গ্যাস ট্রান্সমিশন বা সঞ্চালন করে। ছয়টি কোম্পানি গ্রাহকদের মধ্যে গ্যাস বিপণন করে থাকে। আরও তিনটি কোম্পানির মধ্যে একটি কোম্পানি এলএনজি, সিএনজি, এলপিজি নিয়ে কাজ করে, দুটি কোম্পানি কয়লা ও পাথর উত্তোলন করে।
জ্বালানি বিভাগের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, প্রকৃত অর্থে সরকারকে জ্বালানির জোগান দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কিন্তু এ অবস্থার মধ্যেও দেশে সব কোম্পানিতে গ্যাসের অচপয় অবৈধ ব্যবহার বাড়ছে। কোনো অবস্থাতেই সিস্টেম লস কমানো যাচ্ছে না। তিনি বলেন, পেট্রোবাংলা গ্যাস খাতে বড় ধরনের সংস্কারে কাজ করছে; যার মূল লক্ষ্য গ্যাসের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা। অপচয় রোধ করা এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসা। তিনি বলেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যদি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের মতো জবাবদিহিতার আওতায় আনা যায় তবে সিস্টেম ডেভেলপ করবে।