কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটে বিশ্বের প্রায় সব দেশই কঠিন সময় পার করছে। এর মধ্যে বড় চাপে রয়েছে বাংলাদেশ। বৈশি^ক ও অভ্যন্তরীণ নানামুখী চ্যালেঞ্জের মধ্যেও দেশের অর্থনীতির আকার বাড়ছে। সে রকম পরিকল্পনা নিয়েই এগোচ্ছে সরকার।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫৫ লাখ ৯৭ হাজার ৪১০ কোটি টাকা। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চেয়ে যা ৫ লাখ ৯০ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা বেশি। চলতি অর্থবছরে জিডিপির আকার ৫০ লাখ ৬ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা।
জানা গেছে, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ছিল একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। সে জন্য দেশ পুনর্গঠনই তখন সরকারের পরিকল্পনায় প্রাধান্য পায়। পরিকল্পনা কমিশনের তৎকালীন ভাইস চেয়ারম্যান নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে প্রণীত হয় প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৭৩-১৯৭৭)। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল আড়াই শতাংশ। তখন অবশ্য জিডিপির আকার ছিল ৪ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা। সত্তরের দশকে গড়ে ৩ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হয়। আশির দশকেও এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি। নব্বইয়ের দশকে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রবৃদ্ধির চাকাও ঘুরতে শুরু করে। তবে ওই দশকে প্রবৃদ্ধি ৪-৫ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।
মূলত ২০০০ সালের পর থেকেই দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ পেরিয়ে ৬ শতাংশের পথে হাটে। ২০১০-১১ অর্থবছরে
প্রথমবারের মতো জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে যায় (৬.৪৬ শতাংশ)। ঠিক পাঁচ বছর পর তা ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ৭ দশমিক ১১ শতাংশ। তিন বছরের মাথায় তা ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয় ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। করোনার কারণে প্রবৃদ্ধিতে হোঁচট খায়।
জানা গেছে, জিডিপির আকার অনুসারে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ বিশ^ অর্থনীতিতে ৬০তম ছিল। গত ১৪ বছরের ব্যবধানে ৩৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। যুক্তরাজ্য ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকনোমিক অ্যান্ড বিজনেস রিসার্সের গবেষণা অনুসারে ২০৩৭ সালে বাংলাদেশ ২০তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের এই অর্থনৈতিক সম্ভাবনার পেছনে রয়েছে মূলত দেশের দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যা, জনশক্তি ও বিশাল সংখ্যক মেধাবী কর্মশক্তি। বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। করোনা মহামারীর কারণে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কিছুটা ধীর হলেও ফের ঘুরে দাঁড়াচ্ছে অর্থনীতি।
জানা গেছে, গত ১৪ বছর ধরে দেশের অর্থনীতির কাঠামোয় উল্লেখযোগ্য রূপান্তর ঘটেছে। টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে উল্লেখযোগ্য হারে দারিদ্র্য কমায় বদলে গেছে কোটি মানুষের জীবনযাপন। ২০১৫ সালে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে উন্নীত হওয়ার পর ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নীত হওয়ার পথে রয়েছে। নানা সংকটের মধ্যেও সরকার দেশের অবকাঠামোর উন্নয়নের ওপরও জোর দিচ্ছে এবং গত বছর সরকার তার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ করে তা জনগণের জন্য খুলে দিয়েছে। পদ্মা সেতু রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দেশের এক-তৃতীয়াংশের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করেছে। এছাড়াও এটা আঞ্চলিক যোগাযোগ বাড়িয়েছে এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে আরও সহজ করেছে। এছাড়া রাজধানী ঢাকায় মেট্রোরেল চালু করেছে। দেশের জিডিপিতে এ সব উন্নয়নের ভূমিকা রয়েছে। তবে বৈশ্বিক সংকট বাংলাদেশসহ বিশ্ব অর্থনীতিকে ঝুঁকিতে ফেলেছে।
জানা গেছে, সাম্প্রতিক দশকগুলোতে বিশ্ব অর্থনীতির অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পেছনে যেসব বিষয় অবদান রেখেছে, ধীরে ধীরে সেগুলোর তেজ কমে আসছে। এর ফলে আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্ব অর্থনীতির ‘গতিসীমা’ নেমে আসবে গত তিন দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। চলতি দশকের গড় প্রবৃদ্ধি হবে এই শতকের প্রথম তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এমন উদ্বেগের কথা তুলে ধরা হয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে বাংলাদেশও। তাই এমন সংকটের মধ্যেও আগামী অর্থবছরের জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) চলতি বাজার মূল্যে ৫৫ লাখ ৯৭ হাজার ৪১০ কোটি টাকা নির্ধারণ করেছে অর্থ বিভাগ। স্থিরমূল্যে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে দীর্ঘদিন ধরেই বেসরকারি বিনিয়োগে ধীরগতি চলছে। তবে দীর্ঘ এক যুগ ধরেই বাংলাদেশ উচ্চতর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের ধারা অব্যাহত রাখে। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়োগে গতি না থাকায় প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সরকার নিজেই বিনিয়োগ বাড়িয়ে দিয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলেন, সরকারি বিনিয়োগ বাড়লে বেসরকারি খাতেও বিনিয়োগে গতি আসে।
জানা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে রেকর্ড ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়, যা এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারী করোনার আঘাতে বাংলাদেশ সেখান থেকে পিছিয়ে পড়ে। তবে করোনার অভিঘাত ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সারা পৃথিবী যখন নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে, সেই সময়ও বাংলাদেশে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে খাদ্য ও জ্বালানি পণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা এবং দেশের প্রধান রপ্তানি বাজার ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে মন্দার পূর্বাভাস সত্ত্বেও আগামী অর্থবছরে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে যাচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
সরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। তাই টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, জিডিপি শুধু একটি অঙ্ক নয়। এর মাধ্যমে একটি দেশের অর্থনীতির মান, মানুষের জীবনধারার মানও নির্ণয় করা হয়ে থাকে। ফলে আসছে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে গুণগত মানসম্পন্ন টেকসই উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হবে বলে।