রাজধানীর মিরপুরের ৪৯ শের-ই-বাংলা রোডে অবস্থিত জাফরাবাদ আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিতে শ্রেণিকক্ষের ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। শেওলা পড়ে দেয়াল কালো হয়ে গেছে। এরই মধ্যে কিছু শিক্ষার্থী এখানে পড়াশোনা করছে। কিন্তু পড়াশোনার পরিবেশ নেই। এরকম পরিস্থিতিতে শিশুদের আকৃষ্ট করতে পুরো বিদ্যালয় ভবনকে বদলে ফেলা হচ্ছে। প্রকল্পের পরিচিতি অনুযায়ী, দৃষ্টিনন্দন নবনির্মিত বিদ্যালয় ভবনটি হবে ছয়তলা। এর মধ্যে নিচতলা ফাঁকা থাকবে। অনেকটা মাঠের মতো এই অংশে শিক্ষার্থীরা খেলাধুলা করবে। ২৭টি কক্ষের মধ্যে ১৯টি শ্রেণিকক্ষ থাকবে। প্রতি শ্রেণিতে ৪০ জন শিক্ষার্থী বসবে। ২টি শিক্ষককক্ষ থাকবে। ৩৬টি টয়লেট থাকবে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, শুধু এই জাফরাবাদ আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ই নয়, রাজধানীর ৩৫৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চেহারাই পাল্টে দেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ এসব বিদ্যালয়ের পুরনো ভবন ভেঙে নতুন দৃষ্টিনন্দন ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে রাজধানীর
৩৪২টি পুরনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ১৪টি নতুন বিদ্যালয় রয়েছে। নতুন বিদ্যালয়ের মধ্যে রাজধানীর উত্তরাতে ৩টি এবং পূর্বাচলে ১১টি নতুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ হবে। আগামী জুন নাগাদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্তত ১১টি দৃষ্টিনন্দন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উদ্বোধন করার কথা।
জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ভোরের কাগজকে বলেন, দৃষ্টিনন্দন এসব স্কুলে শিশুদের খেলাধুলার জন্য পৃথক ইনডোর গেমস রুম, অভিভাবকদের জন্য অপেক্ষাগার, শিশুদের উপযোগী ওয়াশরুম ব্লক থাকবে। প্রতিটি ভবনের পৃথক আর্কিটেকচারাল ডিজাইন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে নতুন এই স্কুলগুলো স্থাপন করার উদ্যোগ নিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) এ স্কুল নির্মাণ করবে। একই সঙ্গে রাজধানীর ১২টি থানা এলাকায় থাকা ৩৪২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েই নির্মাণ করা হবে সুদৃশ্য নতুন ভবন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফরিদ আহম্মেদ বলেন, প্রাথমিক স্তরের কোমলমতি শিশুদের আকৃষ্ট করতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে নতুন দৃষ্টিনন্দন ভবন নির্মাণের কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। তিনি মনে করেন, ঢাকা শহরের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো সুন্দর না হওয়ায় শিশুদের আকৃষ্ট করতে পারছে না। এ কারণে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তে আগ্রহী হয় না। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, দৃষ্টিনন্দন ভবন ও শিশুদের আকৃষ্ট করে এমনভাবে ক্লাসরুমগুলো তৈরি করতে। এজন্য আমরা প্রকল্প নিয়েছি। রাজধানীর ৩৪২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়েই দৃষ্টিনন্দন নতুন ভবন নির্মাণ করা হবে। প্রতিটির ডিজাইন হবে স্বতন্ত্র। গ্রামগঞ্জে প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন একই ধরনের। রাজধানীতে তা হবে না। তিনি বলেন, যেসব বিদ্যালয়ের খেলার মাঠ বর্তমানে আছে, তাদের সেই মাঠ রাখা হবে। সব বিদ্যালয় ভবনেই ইনডোর গেমস রুম ও অভিভাবকদের জন্য শেড থাকবে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মতে, ঢাকা মহানগরীর ৩৪২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এই মুহূর্তে প্রায় ২ লাখ ছাত্রছাত্রী পাঠ নিচ্ছে। জানতে চাইলে ঢাকা মহানগরী ও পূর্বাচলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন ও অবকাঠামো উন্নয়নসহ দৃষ্টিনন্দন প্রকল্পের উপপরিচালক এস এম মোর্শেদ বিপুল ভোরের কাগজকে বলেন, ঢাকায় পুরনো ৩৪২টিসহ নতুন ১৪টি বিদ্যালয়ের দৃষ্টিনন্দন ভবন নির্মাণ করতে ১ হাজার ১৫৯ কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে। সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এসব বিদ্যালয় স্থাপন করা হবে। কিন্তু সময় অনুযায়ী প্রকল্পের মেয়াদ শেষ না হওয়ায় আরো বাড়ানো হবে।
তিনি জানান, নতুন ১৪টি বিদ্যালয়ের জন্য জমি পেতে তারা রাজউকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে উত্তরায় তিনটি জমি পেয়ে গেছেন। পূর্বাচলে ১১ বিদ্যালয়ের জন্য জমি বরাদ্দ দেয়ার বিষয়টি রাজউকের বোর্ড সভায় অনুমোদিত হয়েছে। শিগগিরই তারা জমি পাবেন বলে আশা করছেন। বর্তমানে শিশুরা কেজি স্কুল, কিন্ডারগার্টেন ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মানেই গরিবের বিদ্যালয়- এই ধারণা থেকে তারা সবাইকে বের করে নিয়ে আসতে চান।
তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য নিয়ে রাজধানীর প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর অবয়ব ও কাঠামো বদলে ফেলা হচ্ছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- প্রাথমিক শিক্ষায় শিশুদের শতভাগ ভর্তি নিশ্চিতকরণ, দৃষ্টিনন্দন ভবনে শিশুর মানসিক বিকাশ ঘটানো, শিক্ষায় প্রবেশাধিকার, উচ্চশিক্ষা এবং পরিপূর্ণ উন্নতির ধারাবাহিকতার মাধ্যমে সামাজিক বৈষম্য হ্রাস করা, প্রায় দুই লাখ শিক্ষার্থীর জন্য শিশুবান্ধব শিক্ষা গ্রহণের পরিবেশ নিশ্চিতসহ শিক্ষার মান বাড়ানো হবে। নতুন ভবন ছাড়াও ঢাকার পুরনো ৩৪২টি বিদ্যালয় ভবনের মধ্যে ১৫৪টির ২৯৭৫টি কক্ষ নতুনভাবে নির্মাণ করা হবে। আর ১৭৭টি বিদ্যালয়ের ১১৬৭টি কক্ষের অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ দৃষ্টিনন্দন করা হবে।